সরে গেলাম

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর, ২০১৮ ১১:১৯

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


সন্তোষ শর্মা :
রাজনীতি সচেতন হলেও আমি কখনই সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। ছিল না কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ সে তো অনেক দূর। এর পরও জীবনে কিছু সময় আসে, মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়। মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না জন্ম নেয়। অবচেতন মন জেগে উঠে, সবাইকে জানান দিয়ে বলতে চায়, অনেক হয়েছে; এবার কিছু একটা কর।

এভাবেই আমার ‘ডাক’ আসে। রাজনীতিক হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ডাক। প্রথমে দ্বিধায় থাকলেও পরে মন সায় দেয়। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে থাকি। আড়মোড়া কাটিয়ে যে দুজন মানুষের অনুপ্রেরণায় আমি জীবনের বাঁক বদলের এতবড় এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তারা আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা আমার প্রিয় এক দাদা ও বৌদি। এ দুজনই আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। মনোনয়ন নিশ্চিত করা এবং নির্বাচনী খরচের সব আয়োজনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কোনো যোগ্যতা না থাকার পরও একমাত্র দাদার কারণে আমি মহাজোটের প্রার্থী হতে যাচ্ছিলাম। বাবা-মা সমতুল্য এ দুটি মানুষ মাত্র কয়েক বছরে এমনভাবে আমাকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছেন, এ তারই বহির্প্রকাশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে এভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাওয়া মানুষ দুটির এতবড় দানের প্রতিদান আমি দিতে পারছি না। দাদা-বৌদি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের জন্য নিরন্তর প্রার্থনা। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে দাদা-বৌদির সামনে গিয়ে হাতজোড় করে বলি, সরি দাদা, সরি বৌদি।

আমার সহধর্মিণীর নাম বিউটি শিকদার। দাদা-বৌদি তাকে আদর করে ডাকেন সুইটি। দাদা-বৌদির সেই সুইটিও অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে। সব সময় মন খারাপ নিয়ে সময় কাটাচ্ছে। নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দাদা-বৌদির সামনে দাঁড়ানোর সাহস হয়নি। কীভাবে তাকাব তাদের চোখের দিকে? ওই বৌদিই যে পণ্ডিতের কাছ থেকে দিনক্ষণ দেখে শুভলগ্নে আমার মঙ্গল কামনায় পুজো দিয়েছেন। দাদা তো সব আয়োজন করে রেখেছিলেন। তাদের এই ঋণ তো আমি এ জীবনে শোধ করতে পারব না। নির্বাচন করব না, এটা শুনে দাদা বেশ বিব্রতও হয়েছেন, এটা আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি।

যখন আমাকে নির্বাচন করার জন্য বলা হচ্ছিল, আমি বলেছিলাম, বিরোধী কোনো দলের প্রার্থী হব। এর পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও আমি কোনো দলে যোগ দিইনি। কোনো দল থেকে মনোনয়ন ফরমও কিনিনি। এর পরও জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব আমাকে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারে অনেক আগেই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। ২০ নভেম্বর দুপুরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দীন বাবলু ফোন করে আমাকে মহাজোটের মনোনয়ন নিশ্চিতের কথা জানান। এর পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ফোনে একই কথা বলেন। ব্যক্তিগত কারণেই কাদের ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তারা সবাই আমাকে কক্সবাজার চলে যেতে বলেন।

এদিকে মনোনয়নের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কক্সবাজার থেকে প্রচুর ফোন আসা শুরু হয়। সেখানকার আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে, ফোন করে এবং এসএমএস পাঠিয়ে অভিনন্দন জানান। রাজধানীতেও আমার পরিচিত সবাই অভিনন্দন জানান। বর্তমান মন্ত্রিসভার দুই সদস্য আমার নির্বাচনী খরচের পুরো দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। শুভাকাঙ্ক্ষীএকজন ব্যবসায়ী আমার ওপর এক ধরনের চাপ দিচ্ছিলেন নির্বাচন করতে। তিনিও আশ্বাস দিয়েছিলেন যত খরচ হয় দেবেন।

রক্তের সম্পর্ক না হলেও মানুষের অনুভূতি যে কী রকম হয়, এটা আমি বুঝলাম। নির্বাচন করব শুনে স্বল্পদিনের পরিচিত এক ছোটবোন যেমন আনন্দে কেঁদেছেন; সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা শুনে আরও বেশি অশ্রু ঝরিয়েছেন।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেত্রী প্রিয় এ মানুষটাকে কাকিমা বলে ডাকি। তিনি এসএমএস পাঠিয়ে এবং ফেসবুকে আনন্দ উল্লাসের স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

আমার এক প্রিয় বন্ধু (যুগ্ম সচিব) যার সঙ্গে গত ১৮ বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন দুপুরের খাবার খাই। নির্বাচন না করলে তিনি তো আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, আমার চাকরিস্থল দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক এবং মালিকপক্ষ সম্মতি দিয়েছিলেন যেন নির্বাচন করি। এভাবে আশপাশের ভালোবাসার সবার একটাই বক্তব্য, এমন সুযোগ জীবনে বারবার আসবে না। এ সুযোগ কাজে লাগানো উচিত। তাদের পরামর্শ, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে হয় না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ গ্রহণ লক্ষ্মী কি না যেমন জানি না, তেমনি কেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম এ মুহূর্তে তাও বলতে পারব না। হয়তো সারাজীবন সেটা অপ্রকাশিতই থেকে যাবে। তবে আমার সেই দাদা-বৌদি সেটা জানেন। নির্বাচন না করার সিদ্ধান্তের পর নিজেকে কিছুটা নির্ভার মনে হলেও একটি প্রশ্ন বারবার মনে উঁকি দিচ্ছে, যে বা যাদের সম্মান রক্ষার স্বার্থে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলাম, তারা কি আদৌ কোনো দিন এ কথা স্মরণে রাখবে?

নির্বাচন করব কী করব না, এ দ্বিধায় গত এক মাস আমি ও আমার স্ত্রী একদিনও ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। জীবনের কঠিন সময়ে কীভাবে স্বামীকে মানসিক শক্তি যোগাতে হয় তার প্রমাণ দিয়েছে দাদার প্রিয় সুইটি আর আমার প্রিয় শাশ্বত। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহলের বেশ কিছু বন্ধু আমার নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কৌশলগত কারণে আমি তাদের নাম প্রকাশ করে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারছি না। নির্বাচন থেকে সরে আসার পর আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, কক্সবাজারের সব পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর প্রতি। যারা আমার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন। কক্সবাজার-৩ আসনের সব ভোটারের প্রতিও ভালোবাসা রইল। যারা আমাকে তাদের এমপি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। প্রার্থী হলে জয়ী হতাম কিনা জানি না; তবে এমপি না হয়েও আমি সারাজীবন আপনাদের পাশেই থাকব। বিশ্বাস করি আপনারাও আমাকে আপনাদের সঙ্গে রাখবেন।