বিশেষ প্রতিনিধি:
ইয়াবা পাচারের পাশাপাশি স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে টেকনাফ সীমান্ত। তবে সব বাহিনী মাদক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় র্স্বণ চোরাচালান অব্যাহত গতিতে চালাচ্ছে পাচারকারীরা। এতে ব্যবহৃত হচ্ছে র্স্বণ চোরাচালান মামলা হতে জামিনে আসা পাচারকারীরা। কিন্তু আইন-শৃংখলা বাহিনী র্স্বণ পাচার প্রতিরোধে তেমন তৎপর না হওয়ায় দেদারছে চলছে র্স্বণ পাচার। আর এ ফাকেঁ টেকনাফ পৌর সভার কুলাল পাড়া, লামার বাজার, ছোট হাজী মাকেটসহ রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে গড়ে উঠেছে নতুন করে পাচঁ শতাধিক দোকান।

চলতি বছরের জুন মাসে ধরা পড়ে মাত্র ১টি চালান। তাও কোস্ট গার্ড সদস্যদেও অভিযান। এর আগে গত ২০১৫-২০১৬ সালে ধরা পরে ১২ টি চালান। মিয়ানমার থেকে আনা এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তারা। বেনাপোল বারপোতা সীমান্ত থেকে ৫টি স্বণের্র বারসহ শফিকুল ইসলাম নামে এক পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে বিজিবি। গত ২৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকালে বেনাপোলের বারপোতা রহমতপুর এলাকা থেকে তাকে আটক করে । গ্রেফতারকৃত শফিকুল ইসলাম বেনাপোলের পুটখালী গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে।

যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফুল হক জানান, বেনাপোলের পটুখালী সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ পাচার হয়ে ভারতে যাচ্ছে এমন সংবাদ পেয়ে বিজিবি সদস্যরা বারপোতা রহমতপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে শফিকুলকে আটক করে। পরে তার দেহ তল্লাশি করে ৫টি স্বণের্র বার জব্দ করা হয়।

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের জাতিগত দুটি ঘটনায় আইনশৃংখলা বাহিনী রোহিঙ্গ পূর্ণবাসন ও নিয়ন্ত্রন নিয়ে বেশী ব্যয় ও ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে অভিযোন জোরদার করায় র্স্বণ পাচারকারী সিন্ডকেট দিব্ব্যি আরাামে পাচার কাজ চালিয়ে আসছে বলে একাধিক সুত্রে জানা যায়। বাংলাদেশ-মিয়ানমার বৈধ ট্রানজিট যাতায়াত বন্ধ থাকায় এখন র্স্বণ চোরাচালান সিন্ডকেট শাহপরীরদ্বীপ গবাধি পশুর করিডোর ও টেকনাফ স্থল বন্দর ও এর আশপাশ এলাকাকে বেচে নিয়েছে। গত ২০ জুন দিবাগত রাতে টেকনাফে ৪টি স্বর্ণের বারসহ টেকনাফ পৌরসভার খায়ুকখালী পাড়া এলাকার মৃত নুর মোহাম্মদের ছেলে মোঃ আব্দুল্লাহকে (২৮) আটক করে কোস্টগার্ড সদস্যরা। কোস্টগার্ড পূর্বজোনের সহকারী গোয়েন্দা পরিচালক লে. কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল মারুফ জানান, বুধবার রাতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বরইতলী এলাকা (টেকনাফ স্থল বন্দরের পার্শ্বে) থেকে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৪ টি স্বর্ণের বারসহ তাকে আটক করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছর র্স্বণ পাচার রোধের তেমন অভিযান চালাতে পারেনি আইন-শৃংখলা বাহিনী। ফলে বিভিন্ন সময়ে আটক পাচারকারীরা জামিনে এসে ফের র্স্বণ চোরাচালানে নেমে পড়ে। এর ফলে হুন্ডি চক্র তাদের জাল বিস্তার অব্যাহত রাখছে।

একটি সূত্র বলছে, স্থল সীমান্ত দিয়ে আনা কিছু চালান আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়লেও অধিকাংশ চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নির্ধারিত স্থানে নির্বিঘেœ পৌঁছে যাচ্ছে জলপথে ট্রলার মারফত যাওয়া চালান গুলো।

বিজিবি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ২৩ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টার দিকে টেকনাফ বিওপির নায়েব সুবেদার গুরুপদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টহল দল টেকনাফ পৌর এলাকার পুরাতন ট্রানজিট ঘাটে মিয়ানমার থেকে আসা যাত্রীবাহি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে ১১৪ ভরি ওজনের ৮টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। যার বাজার মূল্য আনুমানিক পৌনে ৪৮ লাখ টাকা। এ সময় সংশ্লিষ্ট কাউকে আটক করতে পারেনি বিজিবি জোওয়ানরা।

অপরদিকে, গত ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ জুন টেকনাফে পৃথক অভিযান চালিয়ে বিজিবির সদস্যরা ১ কেজি ৭০০ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। এই স্বর্ণের বাজার মূল্য প্রায় ৬৫ লাখ টাকা।

এ সময় স্বর্ণসহ হাতেনাতে আটক করা হয় তিনজনকে। তারা হলেন- মিয়ানমারের নাগরিক মো. আরাফাত ও মো. রফিক এবং টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়ার মো. ওসমান। মিয়ানমার থেকে স্বর্ণের চালানটি টেকনাফ এনে চট্টগ্রাম রওনা হওয়ার সময় তারা ধরা পড়েন। আরাফাত ও রফিক ওই সময় বিজিবির জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন মিয়ানমারের সঙ্গে টেকনাফের স্বর্ণ চোরাচালান বাড়ছে। মিয়ানমারের মংডু থেকে স্বর্ণ কিনে নৌকায় (নাফ নদী অতিক্রম করে) টেকনাফ আনা হচ্ছে। এরপর টেকনাফ থেকে স্বর্ণের চালান যায় চট্টগ্রামে। সেখান থেকে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে যাচ্ছে ভারতে।

এ দুটি ছাড়াও ২০১৬ সালের ৫ মে, ২৫ এপ্রিল ও ৫ মার্চ অভিযান চালিয়ে বিজিবি সদস্যরা তিনটি স্বর্ণেন চালান আটক করেন। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আটক করা হয় আরো ছয়টি চালান। টেকনাফে বিজিবির উদ্ধার করা স্বণের্র মোট পরিমাণ ১৮ কেজি ২৪৫ গ্রাম (৯৪টি বার)। এসব অভিযানে আটক করা হয় ১৪ জনকে।

বিজিবি জানায়, গত ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল নাফ নদী দিয়ে টেকনাফ এবং টেকনাফ থেকে সড়ক পথে চট্টগ্রামে পাচারের সময় বিজিবির সদস্যরা ১ কেজি ৪২৫ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বণের্র বারসহ টেকনাফের মোহাম্মদ ইদ্রিসকে আটক করেন। এরপর তাকে টেকনাফ থানা-পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

ওই সময় মোহাম্মদ ইদ্রিস পুলিশকে জানান, এর আগেও তিনি টেকনাফ থেকে একাধিকবার স্বর্ণের চালান চট্টগ্রামে নিয়ে গেছেন। চট্টগ্রামে স্বর্ণসহ তিনি আরেকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি আবার স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন।

বিজিবি ও পুলিশ সূত্র জানায়, মিয়ানমার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও ভারতভিত্তিক একাধিক সিন্ডিকেট স্বর্ণ চোরাচালানে যুক্ত। টেকনাফের শাহ পরীরদ্বীপ, সাবরাং বাজার পাড়া , নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, চৌধুরীপাড়া, টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট ঘাট, নাইট্যংপাড়া, টেকনাফ স্থলবন্দর, জাদিমোরা, আলীখালী ও চৌধুরীপাড়া দিয়ে স্বর্ণের চালান আসে। তবে বেশির ভাগ চালান সমুদ্রপথে পাচার হয় বলে ধরা সম্ভব হয় না।

বিজিবি ২ ব্যাটলিয়ান উপ-অধিনায়ক মেজর শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার বলেন, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচারের সময় বেশ কয়েকটি অভিযান অনেক আগে বিজিবি পরিচালনা করেছিলো। সম্প্রতিক সময়ে তেমন অর্জন নেই র্স্বণ পাচার অভিযানের। এখন সে বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যাতে র্স্বণ চোরাচালান রোধ করা যায়।

টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের বিদায়ী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনজিত কুমার বড়–য়া জানান, সমুদ্রপথে স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে এ খবর পুলিশের কাছে আছে। কিন্তু সমুদ্রে নেমে স্বর্ণ কিংবা ইয়াবা চোরাচালান প্রতিরোধ করার মতো আধুনিক জলযান ও জনবল পুলিশের নেই।

ফের সক্রিয় সাইফুল সিন্ডিকেট
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় গত ২০১৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর সকাল আনুমানিক ৮ টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে দ্রুতগামী টয়োটা এলিয়েন প্রাইভেট কার চট্টমেট্রো-গ ১৩-০৭৬৯ থেকে ১ কেজি ৬৬২ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে পুলিশ। যার আনুমানিক বাজার মুল্য ৫২ লক্ষ টাকা । আটককৃতরা- হল গাড়ী চালক কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার গোদারবিল মাঝরপাড়ার আবদুর রহমানের পুত্র কায়সার হামিদ (২১) ও সাবরাং বাজারপাড়ার করিম হাজীর বাড়ির ডা: আব্দুর রহিমের ( কৌশলে পিতার নাম আবদুল আজিজ দেয়) পুত্র সাইফুল ইসলাম সাইফুল।

আটককৃত টয়োটা এলিয়েন কার চট্টমেট্রো-গ ১৩-০৭৬৯ গাড়ীটি কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হলে গাড়ির আরোহীকে এসআই লিটন চন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গাড়িটি সহ আটককৃতদেও লোহাগাড়া থানায় নিয়ে আসে। পুলিশ জানায়, ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর টেকনাফ থেকে চট্টগ্রামে নেওয়ার পথে পুলিশ একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম ওজনের ১০টি স্বণের্র বারসহ সাইফুল ইসলাম ও কায়সার হামিদকে আটক করেছিল। এ সংক্রান্ত লোহাগাড়া থানার (১৯৯৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারা ২৫-এ) এফআইআর নং-৮ , জিআর নং- ৩৩৭/ ২০১৫ ইং। দুজনের বাড়ি টেকনাফে। এর মধ্যে সাইফুলের বাড়ী টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের বাজার পাড়া। সে স্থানীয় ডা: আব্দুর রহিমের ছেলে। অপর জন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদার বিল এলাকার। এ খানে দেখার বিষয় হচ্ছে সাইফুল ইসলাম আটকের সময় তার পিতার নাম আব্দুল আজিজ ও মাতার নাম নুর জাহান বলে জানালেও পুলিশি তদন্তে বের হয়ে আসে অন্য ঠিকানা। আসলে তার পিতার নাম ডা: আব্দুর রহিম ও মাতার নাম দিলদার বেগম। সর্বশেষ সঠিক নামে এই মামলার চার্জশিট দিলেও থানার গোপন রেজিষ্ট্রারে ডিজিটাল তল্লাশি দিলে তার আসল নাম ঠিকানা পাওয়া যায় না। কোন মামলার রেকর্ড পাওয়া যায় না। পিতা আব্দুল আজিজ এই ভূল নামে তল্লাশি করলেই মামলার তথ্য পাওয়া যায়। ফলে সে বেপরোয়া হয়ে র্স্বণ, ইয়াবা ও হুন্ডিসহ বিভিন্ন চোরাচালানে আরো বেশি গতিতে এগিয়ে চলেছে। ফলে প্রাথমিক ভাবে থানার রেজিষ্টাওে তল্লাশি চালানে র্স্বণসহ আটক সাইফুলের নামে কোন মামলার তথ্য পাওয়া যায় না।

কেন এ ধরনের রেকর্ড থানায় লিপিবদ্ধ রয়েছে এমন প্রশ্নে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার ওসি সাইফুল ইসলাম জানান এজাহারে যেভাবে ছিলো হয়ত সেই ভাবেই রেকর্ডটা রয়ে গেছে। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখে যথাযত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও জানান।
এদিকে কারাগার থেকে বের হয়ে এসে সাইফুল সিন্ডিকেট আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। র্স্বণ, ইয়াবা ও হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনার জন্য গড়ে তুলে কয়েকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটে সংযুক্ত করা হয়েছে তার ভাই মাহামুদুল, সাবরাং মগ পাড়ার আজিজুর রহমান ও মো: ইসমাইল, সাইফুলের ফুফাত ভাই সাবরাং চান্ডলী পাড়ার মহিউদ্দিন, সাবরাং মগ পাড়ার ছৈয়দ হোসাইন, দিল মোহাম্মদ। এর মধ্যে মাহামুদুল করিম টেকনাফের দ্বীপ প্লাজা মাকের্টে অবস্থান নিয়ে হুন্ডি এবং ছৈয়দ হোসাইন সাবরাং বাজার পাড়াতে মুদিও দোকানের আড়ালে ইয়াবা পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে কোন চোরাচালানের সাথে জড়িত নয় দাবী করে উক্ত সাইফুল ইসলাম জানান, র্স্বণ পাচার মামলায় নিয়মিত হাজিরা দিয়ে থাকেন তিনি।

টেকনাফ শুল্ক বিভাগের সুপার শংকর কুমার দাস বলেন, মিয়ানমারের স্বর্ণের গুণগত মান ভালো বলে চোরাচালানিরা সেদিকে ঝুঁকছে। তবে টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে র্স্বণ চোরাচালন আমার দায়িত্বকালীন নজরে আসেনি বলেও জানান তিনি।