স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসের পরিচালক মির্জা নাজিমউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালে উনার হার্ট অ্যাটাক হয়। সকাল সোয়া ৯টার দিকে তার ড্রাইভার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তার আগেই তার মৃত্যু হয়।’

সাংস্কৃতিক সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন হাসপাতালে। দুপুর ১২টার দিকে তিনি সাংবাদিকদের জানান, শুক্রবার জুমার পর জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে আইয়ুব বাচ্চুর জানাজা হবে। তারপর মরদেহ রাখা হবে হিমঘরে। তার সন্তানরা বিদেশে অবস্থান করছেন। তারা ফিরলে শনিবার চট্টগ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে জনপ্রিয় এই ব্যন্ড শিল্পীকে।

ব্যান্ড দল এলআরবির লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং প্লেব্যাক শিল্পী। চার দশক ধরে বাংলাদেশের তরুণদের গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখা এই রকস্টারের বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। গিটার বাদনে তার খ্যাতি ছিল পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে।

LRBআইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবরে স্কয়ার হাসপাতালের বাইরে ভক্তদের ভিড়

তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘ফেরারী এই মনটা আমার’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’। এসব গান শ্রোতাদের হৃদয়জুড়ে থাকবে দীর্ঘদিন।

সকালে তার মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। ভক্ত শ্রোতাদের পাশাপাশি সংগীত শিল্পীদের অনেকেই ছুটে আসেন হাসপাতালে। তারা বলতে থাকেন, ‘আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এতো তাড়াতাড়ি তার চলে যাওয়া উচিত হয়নি।’

LRBআইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর

সময় যত গড়ায় ভক্তদের ভিড় তত বাড়তে থাকে। অনেকে এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভিড় সামাল দিতে স্কয়ার হাসপাতালের সামনে ব্যারিকেড বসানো হয়।

হঠাৎ শোনা গেলো ‘কে আর আমারে বাজান কইয়া আদরের ডাক দিবো, বাজান কেমনে তুমি আমাগোরে ছাইড়া যাইতে পারলা’- এমন আর্তচিৎকার। সকাল সাড়ে ১১টায় স্কয়ার হাসপাতালের লবিতে আইয়ুব বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন এক তরুণ।

LRBস্কয়ার হাসপাতালে কুমার বিশ্বজিৎ

জানা গেল তার নাম রনি। আইয়ুব বাচ্চু ফ্যান ক্লাবের অ্যাডমিন। আইয়ুব বাচ্চু তাকে নিজ ছেলের মতো আদর করতেন। গত পরশু মোবাইলে জানিয়েছিল, পরবর্তী শো চট্টগ্রামে। রনি জানায়, ক্লাস ওয়ানে যখন পড়তেন তখন থেকে এবির ফ্যান। তার গান শুনে শুনে বড় হয়েছেন। ২০১২ সালে সরাসরি দেখা হলে ফ্যান পরিচয় পেয়ে বুকে জড়িয়ে নেন। তারপর এবির কোনো কনসার্ট হলে সেখানে ছুটে যান। সবশেষ রংপুরে কনসার্ট শুনতে যান। আজ সকালে তার মৃত্যুর খবর শুনে বিশ্বাস করেননি। পরে ঘনিষ্ঠ একজনের কাছে শুনে নিশ্চিত হয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন।

LRBস্কয়ার হাসপাতালে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ

একপর্যায়ে স্কয়ার হাসপাতাল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন সঙ্গীতশিল্পী রবি চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি এতো সকালে ঘুম থেকে উঠি না। বেশ কজন ফোন করে জানালেন, আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। বিশ্বাসই করতে পারিনি। হাসপাতালে ছুটে এসেছি। বুঝলাম বাচ্চু আর নেই। অঝোরে কেঁদেছি।’

তিনি বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু ছিল এ্যারিস্ট্রোক্যাট। অত্যন্ত হৃদয়বান। ভালো মনের মানুষ। বাচ্চু কী ছিল, তা সবাই জানে। তার স্থান পূরণ হবার নয়। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন, যেন ওপারে ভালো থাকেন। আর ভাষা নেই। আর কিছু বলতে পারছি না।

LRBসাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, হানিফ সংকেতসহ অন্যরা

সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালে ছুটে আসেন সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ। তিনি বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু আমাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করতো। বাসায় আসা-যাওয়া ছিল ভাইয়ের মতোই। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওর জন্য সঙ্গীতাঙ্গন এগিয়েছে বহু দূর।

‘বাচ্চুর সঙ্গে আমার পরিচয় ৮০ এর দশকে। গানের কারণেই আমার সঙ্গে ওর এতো গভীর সম্পর্ক। সারাটা জীবন সে ছিল গানের পাগল, গিটারের পাগল। ওর গানগুলো যেমন ভালো, তারচেয়েও ভালো ছিল ওর মন। ওকে এভাবে হারাবো, কখনও ভাবিনা। বাচ্চুদের জন্ম বারবার হয় না। ওর শূন্যতা কাটানো সম্ভব নয়। সবাই দোয়া করবেন, বাচ্চু ভালো থাকুক, ওর পরিবারের ধৈর্য ধারণের সক্ষমতা বাড়ুক।

LRBস্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল সার্ভিসের পরিচালক মির্জা নাজিমউদ্দিনের সংবাদ সম্মেলন

একটু পরে হাসপাতালে আসেন নায়ক ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংগীতে তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তিনি একজন লিজেন্ড ছিলেন। শেষ স্মৃতি, আমার একটা মুভিতে তার প্লেব্যাক করার কথা ছিল। শেষ যেদিন তার সঙ্গে দেখা হয়, বলেছিলেন, ‘হিরো এত সুন্দর একটা গান গেয়ে দিলাম, আর সিনেমাতে এটা কি করলা! যদি পারো গানটি নিয়ে আবার কাজ কইরো, ফুটিয়ে তুইলো।’

দুপুর ১টার একটু আগে আসেন চলচ্চিত্র পরিচালক দেবাশীষ বিশ্বাস। এর পরপরই আসতে থাকেন সমাজের বিশিষ্টজনেরা।

LRBআইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার ভক্তরা

দেবাশীষ বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন, আছেন, থাকবেন। ওনাকে নিয়ে আজ এভাবে মিডিয়ার সামনে দাঁড়াতে হবে ভাবিনি। ওনার সঙ্গে অনেক স্মৃতি। অনেক গভীর সম্পর্ক ছিল। অনেক পুরনো। ছোটবেলা থেকে ওনার গান শুনে, গিটার শুনে, অনুভব করেই বড় হওয়া। অনেক সময় বলেছি, শরীরের দিকে একটু যত্নশীল হন। একটু সাবধানে থাকেন। উনি বলতেন, ধুর দেবা, আমি তোর থেকেও ইয়াং। ওই কথাগুলো আজও কানে ভাসে।

‘আমরা যারা আইয়ুব বাচ্চুকে চিনি, আমরা সবাই সারাজীবন তার গান ধারণ করে, তার গান লালন করে বাঁচবো। তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি একটাই প্রশ্ন, তিনি কেন আমাদের কথা গুলো শুনলেন না? আমরা তো তার ভালো চেয়েছিলাম।’

LRBবাচ্চু আমাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করতো : ফেরদৌস ওয়াহিদ

দেবাশীষ বলেন, ‘তার সঙ্গে সর্বশেষ স্মৃতি এ বছরই, একটা শোতে। সেখানে প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে বলেছিল, রোদে কেন দাঁড়িয়ে? বলেছিলাম, আমার তো রোদে দাঁড়িয়ে থাকাই কাজ, আপনার যেমন গিটার বাজানো। তার সঙ্গে দেশ-বিদেশের অসংখ্য স্মৃতি।’

বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম কুমার বিশ্বজিৎকে এ সময় দেখা যায় হাসপাতালে। তিনি শুধু কাঁদলেন, কথা বলতে চাইলেন কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বের হলো না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলেই চলে গেলেন।

LRB

তিনি একজন লিজেন্ড ছিলেন : ফেরদৌস

LRBবাচ্চু কী ছিল, তা সবাই জানে : রবি চৌধুরী

দুপুর ২টায় সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পীর মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালে রাখা ছিল।