ইমরান হোসাইন, পেকুয়া


বঙ্গোপসাগর উপকূলের কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় একটি উপজেলা পেকুয়া। এতে রয়েছে সামুদ্রিক আবহাওয়ার বিচরণ, রয়েছে পাহাড় আর প্রাকৃতিক বন। সাগরের লবণাক্ত আবহাওয়া এখানকার মানুষকে যেমন তেজোদ্দীপ্ত করে, তেমনি সবুজ বনাঞ্চলের বিশুদ্ধ অক্সিজেন মানুষের মনে আনয়ন করে শীতলতা। এ দুই ভিন্ন আবহাওয়া যোগান দেয় এ জনপদের বাসিন্দাদের অন্ন। ঘোরায় অর্থনীতির চাকা।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পেকুয়া উপজেলার অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে লবণ উৎপাদন, চিংড়ি চাষ, ধান উৎপাদনে নির্ভরশীল হলেও পরোক্ষভাবে বনাঞ্চলের প্রতি নির্ভরতা কারো কম নয়। সাড়ে এগারো হাজার একর বনভূমি যোগান দেয় উপজেলার আড়াই লাখ মানুষের জ্বালানি কাঠ, মৌসুমি ফল ও নির্মল অক্সিজেনের। আদিকাল থেকে বংশ পরম্পরায় এসব বনভূমির উপযোগিতা ভোগ করে আসছে এ জনপদের বাসিন্দারা। তবে পেকুয়া উপজেলা সৃষ্টির পর থেকে এসব বনভূমির উপর লোলুপ দৃষ্টি দেয় স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতিকারী। তাদের খপ্পরে পড়ে উজাড় হতে শুরু করে সংরক্ষিত বনভূমি। যে ধারা বর্তমানে আরও বেড়ে চলেছে।

স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, সম্প্রতি পেকুয়ায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সংরক্ষিত বনের মূল্যবান গাছ চুরি। অসাধু গাছ ব্যবসায়ীরা স্থানীয় প্রশাসনসহ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে গাছখেকো সিন্ডিকেট। তাই তাদের সাথে পেরে উঠছে না কেউ। এসব সিন্ডিকেটের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়েছে বন রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি রক্ষীরাও। আর তাদের এ অসহায়ত্বকে পুঁজি করে পকেট ভারী করছেন স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

স্থানীয় পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, সংরক্ষিত বনভূমিতে গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল দালান। রাতারাতি স্থাপিত হচ্ছে বসতি। তাছাড়া সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে চালানো হচ্ছে পঁচিশটি অবৈধ করাতকল। তাই কাউকে পরোয়া না করে এসব করাতকলে স্থান পাচ্ছে সংরক্ষিত বনভূমি থেকে চুরি করে কেটে আনা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এতে উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কমে আসছে সেগুন, গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান গাছ।

পরিবেশবাদীরা বলেন, পেকুয়ায় বনাঞ্চলসহ পরিবেশ রক্ষার্থে উপজেলা বন ও পরিবেশ কমিটি থাকলেও এর কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। ইতোপূর্বে উপজেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পাহাড় খেকো, বনভূমি জবরদখলকারী, গাছ চোর সিন্ডিকেট, অবৈধ করাতকল এবং পাহাড়ে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালি আহরণকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করলেও বর্তমান সময়ে অদৃশ্য কারণে তা স্থগিত রয়েছে। গত এক বছরের অধিক সময়ে উপজেলা প্রশাসনের এমন কোন কার্যক্রম দেখেনি স্থানীয়রা। তাই মূলত অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বনাঞ্চলের ত্রাস ‘দা বাহিনী’ প্রধানের সখ্যতার অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশবাদীরা।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্যা ন্যাচার’ পেকুয়া উপজেলা শাখার সভাপতি মাসউদ বিন জলিল বলেন, উপজেলায় তিনটি বনবিটের অধীনে কাগজে কলমে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার একর বনভূমি থাকলেও বাস্তবে তা কমে এসেছে। বন রক্ষায় সরকারের এত আয়োজন থাকলেও শুধুমাত্র নজরদারির অভাবে এসব বন ধ্বংস হচ্ছে। মূলত বন রক্ষায় সক্ষমতা হারিয়েছে বনবিভাগ। ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তারা। এছাড়া বনাঞ্চল রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, বন রক্ষায় দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করায় জ্যামিতিক হারে বাড়ছে বনভূমি দখল। সংরক্ষিত এসব বনভূমিতে প্রতিনিয়তই অবৈধভাবে গড়ে উঠছে বসতবাড়ি। কিন্তু এসব অবৈধ বসতি উচ্ছেদে আন্তরিক নয় বনবিভাগ কর্মকর্তারা। দায়সারা মামলা ঠুকে দায়িত্ব সারেন তারা। এতে অবৈধ দখলদাররা আরো উৎসাহিত হচ্ছে। তাছাড়া, সংরক্ষিত বনের আশেপাশে করাতকল স্থাপন করে বন উজাড়ের প্রতিযোগিতায় মেতেছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী। এসব কারণে প্রতিনিয়ত কমছে বনাঞ্চলের আয়তন, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। আবাসস্থল হারাচ্ছে পশুপাখি।

টইটং বনবিট কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ বলেন, বনের আয়তন অনুপাতে আমাদের জনবল খুবই অপ্রতুল। তবে সীমিত জনবল নিয়ে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করি বনাঞ্চলের গাছ চুরি, জবরদখল রোধ করতে। কিন্তু এতে আশানুরূপ সফলতা মিলছে না।

বিট কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ আরো বলেন, জনবল সংকট ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা না পাওয়ায় অবৈধ করাতকলগুলো বন্ধে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এসব করাতকলে চোরাই গাছ উদ্ধারে গিয়ে অসংখ্যবার হামলাসহ লাঞ্ছিত হয়েছে বনকর্মীরা। প্রতিটি করাতকল মালিক স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। তবে এসব করাতকল বন্ধে উর্ধ্বতন মহলে জানানো হয়েছে।

বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল গফুর মোল্লা বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় বন রক্ষায় আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে জনবল সংকটসহ বিবিধ কারণে গাছ চোর ও বনভূমি দখলদারদের নির্মূলে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া অবৈধ করাতকলের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছ। শীঘ্রই অবৈধ করাতকলগুলো উচ্ছেদ করা হবে।

এব্যপারে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবউল করিম বলেন, বনভূমির অবৈধ দখলদার ও অবৈধ করাতকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় বনবিভাগ কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হবে। খুব শীঘ্রই বনবিভাগের সমন্বয়ে এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।

এব্যাপারে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরীর সাথে দুবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি একটি মিটিংয়ের দোহাই দিয়ে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।