কালের কণ্ঠ:
শ্রাবণে কীর্তনখোলার এখন ভাসানকাল। জোয়ারের পানিতে ডুবুডুবু নগরীর নিচু এলাকা আর খাল-নালা-নর্দমা। ভোটের নগরে কীর্তনখোলার জোয়ার ছাপিয়ে যেন বয়ে যাচ্ছে ‘নৌকা’র জোয়ার। রিকশা-গাড়ি-মোটরসাইকেলে শুধুই নৌকার স্টিকার; শুধুই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ছবি। তবে পোস্টার-লিফলেট, প্রার্থীর গণসংযোগ কিংবা ছোটখাটো পথসভা ছাড়া তেমন উচ্ছ্বাস নেই ‘ধানের শীষে’। ভোটের ঠিক আগে নৌকার এ জোয়ার অতীত স্মৃতিও ফিরিয়ে এনেছে অনেকের; যে স্মৃতিটি কূলে এসে তরি ডোবার। তাই কেউ কেউ এমন জোয়ারকে অতিজোয়ার হিসেবে দেখে আগের মতো ভরাডুবির শঙ্কায় তাগিদ দিয়েছে সতর্কতার। এমনকি সতর্কতামূলক পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে দলের পক্ষ থেকে। বিএনপিও নির্বাচনের শেষ প্রান্তে এসে ‘ঘরের শত্রু’ নিয়ে চিন্তায় পড়েছে। গতকালই কাউন্সিলর প্রার্থী ও জেলা বিএনপির মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আয়েশা তৌহিদা লুনা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগঘেঁষা বিএনপি প্রার্থী আরো আছেন বরিশালে।

শনিবার সকালে রিমঝিম বৃষ্টির মাঝেই নগরীর সদর রোডে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দিয়ে চলাচল করা প্রায় সব মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, রিকশা, এমনকি দোকানপাটেও দেখা যায় নৌকার স্টিকার বা লিফলেট। ওই দৃশ্য দেখিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের একসময়ের ত্যাগী এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা তো আমাদের নৌকার জোয়ার না, বলতে পারেন অতি জোয়ার! ১৯৯৮ সালে এখানে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও এমন অতি জোয়ারের উল্টো ফল পেয়েছিলাম আমরা। তাই ভোটের দিনে আমাদের এবার অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে। সবাই আসল নৌকা, নাকি ভুয়া নৌকাও জোয়ারে মিলে যাচ্ছে কোনো রাজনৈতিক কৌশলের আড়ালে, সেটা মাথায় রাখতে হবে!’

ঠিক তখনই নৌকার স্টিকার লাগানো নাম্বার প্লেটবিহীন একটি মোটরসাইকেল থামিয়ে স্টিকার লাগানোর কারণ জানতে চাওয়া হয়। মোবাশ্বের নামের ওই মোটরসাইকেল আরোহী হাসতে হাসতে বলেন, ‘এইটা থাকলে ট্রাফিকে ডিস্টার্ব করে না। আর বাসার কাছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের পোলাপাইনেও জ্বালায় না—তাই লাগাইছি। ভোট কারে দিব না দিব সেইটা কেন্দ্রে গিয়ে বুঝব।’ এ কথা শুনে আওয়ামী লীগ নেতা ওই আরোহীকে আটকের চেষ্টা করতেই মোটরসাইকেল চালিয়ে দ্রুত কেটে পড়েন তিনি।

পরে নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই আওয়ামী লীগ নেতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য ডা. নাসিম বিশ্বাসের মৃত্যুর পর উপনির্বাচন হয়। নৌকার প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহম্মেদ; আর তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ার (এবার তিনি বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী)। আওয়ামী লীগ নেতা আরো বলেন, সেবার প্রচারণা এমনকি ভোটের দিনেও নৌকার জোয়ার ছিল। কিন্তু দেখা গেল সরোয়ারের কাছে হেরে যান মহিউদ্দীন। আরেকটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়া শওকত হোসেন হিরন পাঁচ বছর নগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন করেও ২০১৩ সালের ভোটে হেরে যান। ওই ভোটের দিনেও ছিল কেবলই নৌকার জোয়ার।

তবে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল মনে করছেন, এবারের নৌকার জোয়ার সত্যিকারের জোয়ার। তবে এর পরও তাঁরা সতর্ক থাকবেন বলে জানান তিনি।

তবে গতকাল বিকেলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর শেষ নির্বাচনী পথসভায় প্রক্যাশেই হুঁশিয়ার করে দেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আফজালুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আগের কোনো কোনো নির্বাচনে দেখা গেছে নৌকার টুপি, গেঞ্জি, ব্যাজ পরে বুথে ঢুকে ধানের শীষে ভোট দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ফলে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে, এবার সেই সুযোগ থাকবে না। নৌকার ব্যাচ ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহারে ভিন্ন কৌশল বা পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে থেকে সার্বক্ষণিক নির্বাচনী কাজে ভূমিকা রাখা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বলরাম পোদ্দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগের জোয়ার আর এবারের জোয়ারের মধ্যে পার্থক্য আছে। এবার জোয়ার স্বতঃস্ফূর্ত। মানুষ সাদিককেই বিজয়ী করবে—এটা আমরা নিশ্চিত।’

বিএনপিতে ‘গৃহদাহ’ : গতকাল এ রিপোর্ট লেখার মধ্যেই খবর আসে, নগরীর সংরক্ষিত ৪ এলাকার কাউন্সিলর প্রার্থী (এর আগেও দুই মেয়াদে কাউন্সিলর ছিলেন) ও জেলা বিএনপির মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আয়েশা তৌহিদা লুনা বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এমনকি গতকাল বিকেলে তিনি অনুসারী কর্মী-সমর্থক নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াত সাদিক আবদুল্লাহর পথসভায় অংশ নিয়েছেন।

ঘরের শত্রু বিভীষণ আরো আছে। বিএনপির মহানগর কমিটিতে আছেন এমন একজন কাউন্সিলর প্রার্থী বলেন, ‘আমরা বিএনপি করি ঠিকই আছে। কিন্তু আমি যদি কাউন্সিলর হিসেবে বিজয়ী না হই তবে দলে আমার গুরুত্ব থাকবে না। সে ক্ষেত্রে আমার দলের মেয়র বিজয়ী হলেও আমার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন আমি হয়তো দলের জন্যও কোনো কাজ করতে পারব না। বরং এখন আমি যেকোনো কৌশলে যদি বিজয়ী হয়ে আসতে পারি তবে দলই লাভবান হবে। এ ছাড়া ধানের শীষের জন্য কাজ করতে গেলে এলাকায় থেকে নিজের জন্য কাজ করাও মুশকিল হবে। তখন দুটিই হারাতে হবে।’ এই কাউন্সিলর প্রার্থী আরো বলেন, ‘আগের নির্বাচন আর এবারকার নির্বাচনের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানেও খুলনা ও গাজীপুরের মতোই ভোট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাতে করে আমাদের ধানের শীষের প্রার্থীর মেয়র হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তাই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হলেও আমরা যে কয়জন বিএনপির কাউন্সিলর জিতে আসতে পারব সেটা অন্ততপক্ষে দলকে স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী করবে।’

জেলা বিএনপির কমিটিতে থাকা একজন সিনিয়র নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, এবার অনেক নাটকীয়তার পর কেন্দ্র থেকে মজিবর রহমান সরোয়ারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। দলে সরোয়ারবিরোধী গ্রুপটি তা ভালোভাবে নেয়নি। এ ছাড়া গত পাঁচ বছর জেলা ও মহানগর বিএনপির অনেক নেতাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্য রেখে চলেছেন; ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। এমনকি বিএনপির বর্তমান মেয়র আহসান হাবিব কামালের অনুসারী বেশ কিছু কাউন্সিলরের বিরুদ্ধেও দলের ভেতরে এমন অভিযোগ রয়েছে। কামাল বা তাঁর কোনো অনুসারী এবার এমনকি পরোক্ষভাবেও মজিবর রহমান সরোয়ারের পক্ষে কাজ করছেন না। বরং উল্টো আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে সখ্য বজায় রাখার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কেন্দ্রে কেন্দ্রে মেয়রের জন্য এজেন্ট দিতেও সহযোগিতা করা হচ্ছে না দলীয় মেয়র প্রার্থীকে—যা এবার ধানের শীষের জন্য বড় এক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ভোটের শুরুর দিকেই কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মীর্জা আব্বাসের উপস্থিতিতে বরিশালে মেয়র প্রার্থী ও বিএনপিদলীয় সব কাউন্সিলর প্রার্থীকে নিয়ে বসেছিলাম। তখন সব কাউন্সিলর প্রার্থীই আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নিজের পাশাপাশি মেয়র প্রার্থীর জন্যও প্রকাশ্যে কাজ করার। পরে অনেকে সেই প্রতিশ্রুতি রাখলেও আমাদের প্রত্যাশা শতভাগ পূরণ হচ্ছে না। অনেকে এখনো মেয়রের জন্য কাজ করছে না। তবে আমরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং আশা করছি তারা ভোটের দিনে ধানের শীষের জন্য কাজ করবে।’

জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চান বলেন, ‘পুলিশ ও আওয়ামী লীগের হয়রানির কারণে এজেন্টদের উপস্থিতি নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। কোনো কোনো এলাকায় কাউন্সিলরাও তেমন একটা সহায়তা করছেন না। যারা এই নির্বাচনে মেয়রের জন্য সঠিকভাবে কাজ করবে না তাদের বিরুদ্ধে ভোটের পরে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ জেলা শাখার মহিলাবিষয়ক সম্পাদক কেন পদত্যাগ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ‘আমরা সবাইকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। প্রশাসন বা আওয়ামী লীগের ভয়ে অনেকে হয়তো কৌশলে কাজ করছে। আর যারা কাজ করবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা আছে।’ অবশ্য এই বিএনপি নেত্রীকেও দলের ভেতরে-বাইরে সরোয়ারবিরোধী বলেই সবাই জানে। তবে এবার তাঁকে সরোয়ারের পাশে থেকেই সক্রিয় নির্বাচন করতে দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে বিলকিস জাহান বলেন, ‘আমি আমার দলের জন্য কাজে নেমেছি। দলই আমার কাছে সবার আগে। তবে একসঙ্গে একই এলাকায় রাজনীতি করতে গিয়ে পদ-পদবি বা প্রার্থিতা নিয়ে মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে আমার কিছুটা দূরত্ব থাকতেই পারে।’