সৈয়দ মোহাম্মদ শাকিল :
রোহিঙ্গা বর্তমান বিশ্বে এক চরম অমানবিকতার শিকার একটি মুসলিম নৃ-গোষ্ঠীর নাম। মিয়ানমার আরকান রাজ্যে সেনা বাহিনীর বর্বরতা থেকে রক্ষা পেতে সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে নতুন করে ১২ লাখের অধিক রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। মানবিকতার কারণে বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গারা আশ্রিত। রোহিঙ্গাদের দেয়া হচ্ছে নানা সুযোগ সুবিধা। মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হেয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার জন্য মেঘা উদ্বাস্ত শিবির বানানো কাজ চলমান রয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্থান দেয়ার জন্য কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘শরণার্থী’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাজ এগিয়ে চলছে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ক্রমশঃ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বেপরোয়া হয়ে উঠছে ইতিহাসের বর্বরোচিত নির্যাতনের শিকার উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা গোষ্ঠী। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন, হানাহানি, মারামারি এগুলো প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া ইয়াবা পাচার, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের অনেকেই। এসব কারণে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা।
উখিয়ায় শনিবার (৭ জুলাই) গভীর রাতে মধুরছড়া ক্যাম্পের নুরুল আলমের ছেলে মোঃ আলম প্রকাশ পেঠান (২৫)কে গলায় ফাঁসদিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মধুরছড়া ক্যাম্প থেকে দুই জনকে আটক করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে, উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে একটি ঘরে ঢুকে এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে রোহিঙ্গা যুবক। এ সময় শিশুটির চিৎকারে ওই ঘরের লোকজন ও প্রতিবেশী জড়ো হয়ে ধর্ষণচেষ্টাকারীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। শনিবার (৭ জুলাই) রাত ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
উখিয়া থানার পরিদর্শক(তদন্ত) খায়রুজ্জামান বলেন, শনিবার খুনসহ পৃথক ঘটনায় তিনজন আটক করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রেম ঘটিত কারনে খুন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। খুন, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকরা। জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও এখানে প্রতিনিয়ত ঘটছে। রোহিঙ্গাদের এধরণের আগ্রাসী আচরণে স্থানীয়দের মধ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
স্থানীয় লোকজন এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণহীন চলাফেরা করছে। মনে হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও তাদের কাছে অসহায়। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও উদ্বিঘ্ন। বিশাল এই ক্যাম্পে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারে থাকা কালীন সময়ে বিভিন্ন বিরোধের জের ধরে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ন সম্পাদক সাংবাদিক নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দীর্ঘসুত্রতার কারণে শরণার্থী ক্যাম্পে সংঘাত বাড়ছে।
তিনি বলেন, ক্যাম্পে এখন যা ঘটছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। আমরা এ ধরণের কর্মকান্ড কোনোভাবেই সমর্থন করি না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ১১ মাসে ১৭টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আরও দেড় শতাধিক বড় ধরনের অপরাধকাণ্ড ঘটিয়েছে মিয়ানমারের এই নাগরিকরা। খুন ছাড়াও তাদের অপরাধের মধ্যে ধর্ষণ, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, ডাকাতির মতো ঘটনা রয়েছে। অপরাধকর্মের কারণে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে জেলে দিয়েছে আরও শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫শে আগস্টের পর থেকে টেকনাফ এবং উখিয়া থানায় রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় ৪০৬ জনকে আসামী করে ১৬৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম অস্ত্র আইনের ১২টি মামলায় ৩০ জন, মাদক আইনের ৫৮টি মামলায় ৮৯ জন, পাসপোর্ট আইনের ৪১টি মামলায় ৭১ জন, ধর্ষণ আইনের ২টি মামলায় ২ জন, অপহরণ আইনের ৩টি মামলায় ৯ জন, চোরাচালান আইনের ৫টি মামলায় ১২ জন, চুরি আইনের ১টি মামলায় ১ জন এবং ডাকাতির আইনের ৫টি মামলায় ২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, রোহিঙ্গাদের অপরাধের এ মাত্রা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়েছেন স্থানীয়রা। প্রশাসন সর্বদা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এরপরও যদি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ সংগঠিত হয়, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একে এম ইকবাল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনাকাঙ্খিত ঘনটা গুলো দুঃখজনক। রোহিঙ্গারা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে তা ক্রমশঃ দৃশ্যমান হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সব সময় প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। তাই আমরা মনে করি মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্কই থাকবে। রোহিঙ্গাদের ইদানিং কর্মকান্ড ভাবিয়ে তুলছে প্রশাসনকে। আমারা রোহিঙ্গাদের সার্বিক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখছি। দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা সর্বদা সর্তক।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিবিরগুলো অপরাধের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। নানা জটিলতার মুখে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় অপরাধ প্রবণ রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে।
২০১৭ সালের ২৪ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ‘জাতিগত নিধনের’ শিকার হয়ে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে আশ্রিত রয়েছে আরও প্রায় সাড় তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। যুগ যুগ ধরে মানবাধিকারবঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানবিক কারনে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।