ডেস্ক নিউজ:

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা করছে বিএনপি। কৌশল হিসেবে সদ্য সমাপ্ত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে সরকার ও কমিশনের সমালোচনায় সরব দলটির নেতারা।

নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরাও এ নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।

নির্বাচনকালীন দলীয় সরকার থাকায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও পরে প্রত্যেকটি স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। এসব নির্বাচনে বিএনপির কোথাও জয়, আবার কোথাও পরাজয় হয়েছে। জয় হলে সরকারের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিফল এবং হেরে গেলে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা, সরকারের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকার অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির নেতারা।

সূত্র জানায়, খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে পুঁজি করে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা করছে বিএনপি। দেশের জনগণ ছাড়াও বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার, বিদেশি গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়মিত এসব বিষয়ে সুর্নিদিষ্টভাবে ব্রিফ করছে বিএনপি।

গত বৃহস্পতিবার (২৮ জুন) মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুম বার্নিকাট বলেন, ‘খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অনিয়ম-জালিয়াতি এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের গ্রেফতার-হয়রানির খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।’ বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কিনা- তার সঙ্গে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের পরিকল্পনাকেও মিলিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একই গণতান্ত্রিক নীতি ও ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিষয়টি দুই দেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। আর ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।’

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বার্নিকাট বলেন, ‘ওই স্থিতিশীলতা কেবল অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রক্ষা করা সম্ভব। বাংলাদেশ সরকার অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ, যেখানে বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে। বাংলাদেশ সরকার সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। আমরা সেটাই দেখতে চাই।’

বার্নিকাটের এমন মন্তব্যের পরের দিন শুক্রবার (২৯ জুন) সন্ধ্যায় সফররত যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও কমনওয়েলথ কার্যালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চল বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ডের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বারিধারায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের বাসায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। অপরদিকে ব্রিটিশমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক।

জানা যায়, দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, খালেদা জিয়ার মামলা, খুলনা-গাজীপুরের নির্বাচন ও আসন্ন তিন সিটির নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।

সেদিন (শুক্রবার) ঢাকায় এসেই দুপুরে যুক্তরাজ্য হাইকমিশনারের বাসায় রোহিঙ্গা ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন মার্ক ফিল্ড। সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাজ্য। যেখানে সব দল ভূমিকা রাখবে। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের এখানকার নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। নির্বাচনের পর যে সরকার গঠিত হবে, তাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে।’

গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার অন্যতম মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কি গ্রুপ (ইডব্লিউজি) পরিচালক ড. আব্দুল আলীম বলেন, গাজীপুর নির্বাচনে ৪৬ শতাংশ ভোট কেন্দ্রে কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পর্যবেক্ষকরা যেসব কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছেন সেগুলোর ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ কেন্দ্রে ১৫৯টি অনিয়মের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। অনিয়মের ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই দুপুরের পর সংঘটিত হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে গত ২৭ জুন গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলন করে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘এটি নির্বাচনের নামে শুধুমাত্র তামাশা। ভোট ডাকাতির নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ চলছে। এ নির্বাচনের ফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।’

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ওই নির্বাচন বাতিলের দাবি জনালেও বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানান তিনি। ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ ওই তিন সিটিতে অংশ নেয়া বলে দাবি করেন ফখরুল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহামুদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ করেনি, করেছে পুলিশ, আর তাদের সহযোগী ছিল নির্বাচন কমিশন। এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পেছনের কারণ হলো, আমরা জনগণের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করতে চাই যে, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহীতে যদি খুলনা ও গাজীপুর স্টাইলে নির্বাচন হয়, তাহলে দুটো জিনিস আমরা জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে পারবো। তা হলো- এক, দেশের মানুষের কাছে আমরা প্রমাণ করতে পারলাম দলীয় সরকারের অধীনে কোনো দিন নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না; দ্বিতীয়টি হলো- নতুন করে চিন্তা করতে হবে যে সাধারণ নির্বাচনে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে কোনো অবস্থাতেই আমরা নির্বাচন করব কিনা? আগামী তিন সিটি নির্বাচন সেই পথ দেখিয়ে দেবে।’

‘সুষ্ঠু নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তল্পিবাহক ও আজ্ঞাবাহক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানকে সংবিধানে যে অধিকার দেয়া হয়েছে, যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে- সেই ক্ষমতা প্রয়োগের মতো শক্তি, ক্ষমতা বা সাহস এ নির্বাচন কমিশনের নেই। যার জন্য এ কমিশন থাকা না থাকা একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে এ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিও জানান তিনি।