ছবি-এডভোকেট এস.এ.এম রফিক উল্লাহ

তৌফিক উল্লাহ রফিক (শাকিল) :

বঙ্গোপসাগর এবং বাঁকখালী নদীর তীর ঘেষে একটি অপরূপ এবং ব্যতিক্রমী দ্বীপের নাম মহেশখালী। সময়ের প্রবাহে বিভক্ত মহেশখালীর ইউনিয়ন বড় মহেশখালী’রএকটি গ্রাম নাম তার জাগিরাঘোনা,আমার দাদার বাড়ী। একদিকে সমুদ্রের গর্জন, আবার অন্যদিকে নদীর পাড় ঘেঁষে প্যারাবন, সারি সারি আম-কাঁঠাল-নারিকেল-সুপারী-তাল গাছের শীতল ছায়া, বাঁশ ঝাড়, বাবুই-শালিকের তীব্র কলকাকলি সব মিলিয়ে ভীষণ ভালো লাগার এই গ্রাম। এই গ্রামেরই একটি যৌথ পরিবারে পৌষের এক আমেজি সোনালী রৌদ্দুরে আমার পিতা এস.এ.এম রফিক উল্লাহ’র জন্ম। আমার পিতামহ মকবুল আহমেদ ছিলেন পেশায় মোক্তার, জীবন নিবেদিত সমাজকর্মী। আর দাদী কুলসুম বেগম। উল্লেখ্য, পিতামহ মকবুল আহমেদ ১৯১৯ সালে এন্ট্রান্স (এস.এস.সি সমমান) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মকবুল আহমেদ তৎকালীন শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক প্রবর্তিত ঋণ সালিসি বোর্ড, মহেশখালী’র চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি একাধারে বড় মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং কক্সবাজার লোকাল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। শ্রদ্ধেয় পিতামহ মকবুল আহমেদ মোক্তারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমান মহেশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মহেশখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড় মহেশখালী মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি। তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজের অনন্য দৃষ্টান্ত হলো গোরকঘাটা-জনতাবাজার সড়ক নির্মাণ, মহেশখালী দাতব্য চিকিৎসালয় (বর্তমান মহেশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) এবং বিভিন্ন এলাকায় নিরাপদ পানি নিশ্চিতকল্পে পাকা কুয়া খনন।

১৯৩৭ সালের ২রা ডিসে¤র^ দুই কন্যার পর প্রথম পুত্র সন্তান লাভে বাড়ীতে মহা উল্লাসের এবং মহাতুষ্টির উপলক্ষ্য হয় । প্রথমপুত্র সন্তান প্রাপ্তিতে দাদী কুলসুম বেগম এর আনন্দ নিশ্চয় সেদিন খর¯্রােতা নদীর মত ভেসেছিল। আর দাদা মজেছিলেন প্রবল খুশীর সুখ সন্ধিক্ষণে। আমার পিতার শৈশব কেটেছে নদীবিধৌত পলি মাটি মাড়িয়ে, বর্ষায় কাদামাটি মেখে মাছ ধরে, শীতের মিষ্টি রোদ অবগাহনে, জোনাক জ্বলা রূপালি জোৎ¯œা রাঙিয়ে, ঝিঁঝিঁর ডাক শুনে, দীঘির শাপলা ফুল তুলে। অন্যদিকে পিতা মকুবল আহমেদের ছিল সন্তান ঘিরে বহুমাত্রিক আশার স্বপন।তাঁর মানসপটে আঁকা ছিল উচ্চ শিক্ষিত, সৎ, ন্যায় নীতি সম্পন্ন এক সমাজ সংস্কারক পুত্রের প্রতিচ্ছবি। তাই পুত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং পড়াশুনার ব্যাপারে দাদার ছিল সুতীক্ষè নজরদারি। তবে তিনি পুত্রের ব্যাপারে যেমন সচেতন ছিলেন তেমনি ছিল ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনের পুত্র-কন্যাদের শিক্ষিত করার তাগিদ।

দাদীর কাছে শুনেছি বাবা রফিক উল্লাহ সাহেব অত্যন্ত সহজভাবে গ্রামের মানুষের সাথেমিশতেন এবং তাদের আপন করে নিতেন। আমৃত্যু ছোট খাটো ছিপছিপে পাতলা গড়নের ছিলেন বলে দাদী কুলসুম বেগমের ছিল অন্তহীন চিন্তার বলিরেখা। বাবার ছিল পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধূলার প্রতি বিশেষ ঝোঁক। ফুটবল এবং সাঁতারের প্রতি ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। সাঁতারে পারদর্শীতা তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও প্রতিভাত হয়। পুত্রের কোনো কাজে বাধা না দিয়ে বরং উৎসাহ প্রদান করে দাদা-দাদী বিস্তৃত মানসিকতার পরিচয় দিতেন এবং মুক্ত পরিবেশে সন্তানের বিকাশ ঘটাতে চাইতেন। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নিজ পিতৃদেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মহেশখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ণ শেষে তদানন্তীন কক্সবাজার ইংরেজী উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯৫৪ সালে প্রবেশিকা (এস.এস.সি সমমান) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে আই.এ পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে (সম্মান) ¯œাতক এবং গরষরঃধৎু ঝপরবহপব’ এ ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। পরের বছর ১৯৬০ সালে একই বিদ্যাপীঠ হতে অর্থনীতিতে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ঐ বছর সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত রফিক উল্লাহ জেলা এগরিকালচারাল মার্কেটিং অফিসার হিসাবে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় ১৯৬৮ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমন করেন। সেখানে তিনি ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি হতে এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং বিষয়ে এক বছরের বিশেষ প্রশিক্ষন কোর্স গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৯ সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি হতে ”ঈড়সসঁহরপধঃরড়হ” এর উপর বিশেষ সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেন এবং উক্ত বছরেই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭০ এর ১৮ ই জানুয়ারি কক্সবাজারের প্রখ্যাত আইনজীবি জনাব মোমতাজুল হকের জেষ্ঠা কন্যা জনাবা জয়নাব আক্তার বেগম (বুলবুল) এর সাথে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে ১৯৭৩ সালে সরকারী চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে কক্সবাজার আদালতে আইনজীবি হিসাবে যোগদান করেন। কিশোর বয়সেই পিতা রফিক উল্লাহ সাহেবের মধ্যে অধিকার সচেতনতা, সংগ্রামী চেতনা এবং প্রতিবাদী মনোভাবের চারিত্রিক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রগতিশীল রাজনীতির স্বাদ তিনি ছাত্র অবস্থাতেই নেওয়া শুরু করেন। তাইতো ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে কক্সবাজার ইংরেজী বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় খালেদ মোশাররফের (মুক্তিযুদ্ধের কে ফোর্সের কমান্ডার) নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রদের সাথে মিছিলে যোগ দেন এবং স্লোগানে স্লোগানে কক্সবাজার শহরকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রকম্পিত করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ পূনর্গঠন-পুনর্জীবনের কার্যকলাপ শুরু হয় তখন আমার পিতা রফিক উল্লাহ সাহেবও সেই কাতারে শামিল হন। বিশেষ করে তরুণ যুবকেরা বুঝতে পেরেছিলএই শেখ মুজিবই বাংলার মুক্তির দূত এবং আশীর্বাদ, এতে সবার মত তাঁর মনেও অন্যরকম প্রাণের শিহরণ জাগত। যদিও দায়িত্বশীল সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় তিনি প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামীলীগে যোগাদান করতে সক্ষম ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী এবং আওয়ামীলীগের কার্যক্রমে পরোক্ষ সহযোগিতাকারী সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের তালিকায় রফিক উল্লাহ সাহেবের নামও যুক্ত ছিল বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়। অবশেষে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি নিজের ভাগ্যকে জনতার ভাগ্যের সাথে যুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র সংগ্রহের জন্য মহেশখালী থানা আক্রমন করেছেন আরো অনেকের সাথে। হয়েছেন সরকারী সম্পত্তি ওঅস্ত্র লুনঠন মামলার আসামি।অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে সমগ্র কক্সবাজার জেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন,উড়িয়েছেন স্বাধীনতার বিজয় কেতন। যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের জান্তা কর্তৃক রাজনৈতিক-পারিবারিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তুএত ত্যাগের পরেও কখনো সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্য লালায়িত হন নি।

অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূ-সম্পত্তির অধিকারী পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান আবার লোভনীয় সরকারী চাকুরী সবকিছু মিলিয়ে তিনি চাইলেই বিত্ত বৈভব কিংবা চরম আয়েশী জীবনে অভ্যস্ত হতে পারতেন। কিন্তু পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, রক্তের উত্তারাধিকার বইতে চলে এলেন নিজ এলাকায়, সাথী হলেন অবহেলিত, অত্যাচারিত সর্বসাধারণের। আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতি এবং সমাজ সংস্কার তাকে প্রলুব্দ করল। আমার পিতা আমৃত্যু বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কক্সবাজার জেলা শাখার সহ-সভাপতি এবং মহেশখালী উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন সাধনে সমবায় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই তো তিনি ছিলেন চেয়ারম্যান-কক্সবাজার কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক, সভাপতি-মহেশখালী কো-অপারেটিভ সোসাইটি, সম্পাদক-বড় মহেশখালী মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতি, সদস্য, চট্টগ্রাম লবণ উৎপাদক সমিতি। পিতা মকবুর আহমেদের মত শিক্ষা বিস্তারে ব্রত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মহেশখাী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় যা পরবর্তীতে জাতীয়করণ হয়। সামরিক শাসনরত অবস্থায় ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরবর্তী মহেশখালীতে যে জনসভা তা আমার পিতা রফিক উল্লাহ সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এতে তার দৃঢ়চেতা সংগ্রামী মনোভাবের প্রকাশ পায়। গোরকঘাটা ঘাটের উন্নয়ন সাধন, অব্যবস্থা নিরসন, জুলুম নির্যাতন নির্মূলের জন্য তিনি ছিলেন আজীবন সোচ্চার। নদী পারাপারে প্রতিদিন জীবন-মৃত্যুর সাক্ষাৎ, যাত্রীদের মাথার উপর প্রকৃতির অমোঘ খেলা এবং ঘাটের আধুনিকায়নে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই ঘাটের অব্যবস্থপনার শিকার হয়ে সমুদ্রের গভীরতায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সরকারকে নিরাপদ নদী পারাপারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করালেন।এর কিছুকাল পরে মহেশখালী ঘাটে জেটি নির্মাণ তার অকাল বলিদানের ফল বলে মনে করেন স্থানীয় অধিবাসীরা।

বর্তমানে মহেশখালীতে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের পরিকল্পনা বা চিত্র দেখতে পাই, যেমন মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দর, সোনাদিয়ায় বিশেষায়িত পর্যটন কেন্দ্র, মহেশখালী মৎস সম্পদ উন্নয়নের প্রকল্প। আমার অবাক লাগে আমার পিতা রফিক উল্লাহ সাহেব চল্লিশ বছর আগে এইসব সম্ভাবনার কথা তার বিভিন্ন লেখনীতে উল্লেখ করেছেন। তিনি মহেশখালী সোনাদিয়াকে ঞযব এড়ষফ ঈড়ধংঃ নামে তার প্রবন্ধে অবিহিত করেছেন। তিনি বলতেন এই মহেশখালী একদিন বাংলাদেশের ইঁংরহবংং ঐঁন হবে,যা বর্তমানে দৃশ্যমান কিংবা বাস্তবায়নের পথে।

প্রখর বুদ্ধি ও জ্ঞানের অধিকারী মানুষটি ছিলেন স্বল্পভাষী, স্পষ্টভাষী এবং বুকে প্রবল সাহস ধারণ করতেন। নিপাট পরিপাটি মানুষটি কখনো ক্লাবে, আসরে কিংবা চা দোকানে আড্ডা দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না। তবে তিনি বন্ধুবৎসল ছিলেন । আমার পিতার সহপাঠী বন্ধুদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিকান্দার খান, সাবেক সচিব- তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ.জেড.এম নাসির উদ্দীন, সাবেক সচিব- তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা- হাসনাত আব্দুল হাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মাহবুবুর রহমান খান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী, আয়কর বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা মোহাম্মদ উল্লাহ, সাহিক প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার নুরুল আলম চৌধুরী, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পদস্থ কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক এম.এন.এ এ্যাডভোকেট নূর আহমেদ, ডাক্তার রেজা খান প্রমুখসহ আরো অনেকে। ছাত্র অবস্থা হতে তার প্রগতিশীল রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এম.এ আজিজ, এম.এ মান্নান, তোফায়েল আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আখতারুজ্জামান বাবু, এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরী, নুরুল আলম চৌধুরী, আফসার কামাল চৌধুরী, এ.কে.এম মোজাম্মেল হক, মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, উসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, এস.কে শামসুল হুদা, ডাক্তার শামসুদ্দিন আহমেদ, এ্যাডভোকেট আহমেদ হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রাব্বান সহ অনেকে।

ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনেও আমার পিতার নিগূঢ় দায়িত্বশীল ভূমিক আমরা দেখেছি।নিরহঙ্কার এবং মিতব্যয়ী পিতার সবচেয়ে অপ্রিয় বিষয় ছিল বিলাসিতা এবং অপ্রয়োজনীয় খরচ। নিজের পরিধেয় পোষাকের বেলায় সুতা বা খদ্দের পাঞ্জাবী- পায়জামা, স্যান্ডেল সু ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। খাবারের বেলায় তার পছন্দের শীর্ষে ছিল ভাত- মাছ- সবজি। পারিবারিক জীবনে দায়িত্বশীলতার প্রমাণ পাওয়া যায়- এত ব্যস্ততা যেমন পেশাগত, রাজনৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের পরেও পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, পুত্রদের পড়াশুনার ব্যাপারে কঠোর নজরদারি। আমার বাবাকে দেখেছি তার মাতা, বোন ও অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের প্রতি দায়িত্ব পালনে সজাগ দৃষ্টি। তাইতো পিতার অকাল মৃত্যুতে আত্মীয় পরিজনদের অধিক কাতর এবং অতিমাত্রায় শোকে বিভোর হতে দেখেছি।

লেখার এই পর্যায়ে এসে কিছু বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। বস্তুত, আমরা চার ভাই-বোন ক্রমে যতই বড় হতে শুরু করি ততই পিতৃহীনতার তীব্রতা অনুভব করি। যেমন কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের দেখে কাতর হতেন কিংবা সমব্যাথি হতেন এই ব্যাপারটা আমাদেরকে অসম্ভব ভারী করে তুলতো, সম্মুখ দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতো। বিশেষভাবে আমার ভাবনায় আসতো আমার ছোট বোনের কথা, বাবা যখন আমাদের ছেড়েযান ,সেই ১৯৮৪ সালে দুই বছর বয়সে যার কাছে বাবার স্বভাবতই কোনো স্মৃতিই ছিল না। ভাবতাম আমরা তিন ভাই বয়সক্রমে কিছু দিন বাবাকে কাছে পেয়েছি, সে তো কোনোদিন বাবা বলে ডাকতে পারে নাই! তার মধ্যে পিতৃহীনতার ব্যথা কতটুকু প্রকট হতে পারে!!

আরো কিছু ঘটনা আমাকে নাড়া দেয় যেমন আমি ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ লিখিত পরীক্ষার সময় হল এক্সামিনার আমার খাতা এবং অ্যাডমিট কার্ড চেক

করতেই বললেন কক্সবাজারের রফিক উল্লাহ সাহেব কি তোমার বাবা ? পরে অবশ্য উক্ত দু’জনের পরিচয় জানতে পারি। তখনই ভাবি সবকিছুতে পিতার অদৃশ্য ছায়া ক্রিয়াশীল।একটা ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়- কয়েক বছর আগে মহেশখালীতে এক যুবক রিক্সাওয়ালার যাত্রী হয়ে যখন উঠলাম কিছুক্ষণ পরে সে জিজ্ঞাসা করলো আপনি কি এখানে বেড়াতে এসেছেন ? আমি বললাম বেড়াতে তো অবশ্যই তবে আমার বাড়ি মহেশখালী। পরে সে আমার পরিচয় জানতে পেরে রিক্সা থামিয়ে বললো আপনার বাবাকে আমরা দেখিনি তবে আমার বাবারা (রিক্সাওয়ালার যুবকের বাবা) আপনার পিতাকে এখনো স্বপ্নে দেখে। এটা রিক্সাওয়ালা যুবকের এক ধরনের ভাবের প্রতিকী প্রকাশ। এতে আমার পিতার স্বল্প পরিসর জীবনে সাধারণ জনগণের সাথে সং¯্রব এবং তার সম্পর্কে উচ্চকিত মনোভাবের পরিচয় খুঁজে পাই। বস্তুত তিনি এমন একজন যিনি তাঁরক্ষুদ্রজীবনেমানুষকে ছুঁয়ে গেছেন, দিয়ে গেছেন অনেক কিছু ।

আরো মনে পড়ে বাবার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মহেশখালী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিতি।উল্লেখ্য ১৯৮৪ সালে ৬ই মেউক্ত বালিকা বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর কয়েক সপ্তাহ পরে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি সভায় যোগদানোত্তর কক্সবাজার ফেরার পথে ভয়াবহ নৌদূর্ঘটনায় পতিত হন, এ যেন অভিশপ্ত ঘাটের বিরুদ্ধে নিজের জীবনের বিরুদ্ধে শেষ প্রতিবাদ।

উল্লেখ করতে মন চায় , এমন সময় ছিল যখন কক্সবাজারে বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন শুধুমাত্র সভা বক্তৃতা কিংবা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উক্ত জাতীয় দিবস উদযাপনের অংশ হিসাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং সৃজনশীল পর্বের কিংবা প্রতিযোগীতার আয়োজন থাকতো। এ সকল আয়োজনে যেমন কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা, উপস্থিত বক্তৃতা অথবা বিতর্ক পর্বে শিশু-কিশোর, তরুণদের সাথে বয়ঃজৈষ্ঠ্যদেরও স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ থাকতো। আমরা তিন ভাই এই ধরণের আয়োজনে বাবার সাথে উপস্থিত হতাম এবং বিভিন্ন মননশীল পর্বে অংশগ্রহণ করতাম। এই ধরণের সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বাবার সহযোদ্ধা ও সমসাময়িকদের সাবলীল অংশগ্রহণ শৈশবে যেমন আমাদের বিমোহিত করতো এবং আজীবন প্রণোদনা হয়ে থাকলো।

তাই তো এখনো জীবনে চলার পথে সময়ে-অসময়ে, সফলতায়-বিফলতায়, পূর্ণতায়-অপূর্ণতায় সবসময় পিতাকে খুঁজি। মনে হয় তিনি বেঁচে থাকলে জীবনটাই হয়ত অন্যরকম হতো। প্রায়শই বাবা ডাকতে ইচ্ছা করে, বাবার সান্নিধ্য লাভের জন্য লোভ জাগে, কিন্তু সহ¯্র আর্তনিনাদ কিংবা চিৎকারে তিনি সাড়া দিবেন না কখনো।

এই লেখনীতে আমাদের মমতাময়ী মাতার কথা উল্লেখ না করলে অসমিচীন হবে। পিতার অবর্তমানে তাঁর অকাল বৈধব্যকে শক্তি এবং সাহসে রূপান্তরিত করে আমাদের আগলে রেখেছেন এখনো, সন্তানদের সমুদয় মঙ্গলের কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন। আমাদের কোনো কিছুতেই এতোটুকু ঘাটতি বা অপূর্ণতা চান নি, পিতা এবং মাতার সমান্তরাল দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবন সংগ্রামী মাতা ধৈর্য, ত্যাগ, সহমর্মিতা, সাহস তদুপরি ব্যবস্থাপকীয় সক্ষমতা দিয়ে তার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্মান, চার পুত্র-কন্যা এবং জাগতিক অবলম্বন সমূহের এতোটুকু ম্লান বা ক্ষুন্ন হতে দেন নি।

সবশেষে বলতে চাই আমার পিতার মৃত্যুর এত বছর পরেও তিনি আপন শিক্ষায়, কর্মে, সংস্কারে, পুনর্গঠনে, প্রতিবাদে, সংগ্রামে এবং সাধারণের ভাবনায় সতেজ ভাস্মর হয়ে আছেন। কেন জানি মনে হয় কালের বিবর্তনে আমার পিতা রফিক উল্লাহ সাহেবের সত্তা¡র অনুসদ্ধান, শিকড়ের নির্যাস , বর্তমান এবং আগামীতে সাহসী প্রজন্ম নির্মাণে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।