রহিম আব্দুর রহিম :

কনকনে শীত, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, ২০ এপ্রিল ২০১৮ এর ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের দূর্গম এলাকার একটি বাড়ি থেকে ‘অরোরা’ নামের তিন বছর বয়সের এক শিশু বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। শিশুটি যে কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। বাড়ির কেউ তা জানেনা। শিশুটির আত্মীয় স্বজন তন্নতন্ন করে খুঁজে ফিরছে; কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে অভিভাবক মহল বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত জানাতে বাধ্য হয়। ১৫ ঘন্টা খোঁজাখোঁজির এক পর্যায়ে ওই বাড়ির ম্যাক্স নামের পোষা অন্ধ কুকুরটিকে তারা খুঁজে পায়। প্রভুর আগমন টের পেয়ে অন্ধ ম্যাক্স তাদের গায়ে ঠেলে ঠেলে হারিয়ে যাওয়া ‘অরোরা’র কাছে নিয়ে যায়। পাহাড়ঘেরা দুর্গম এলাকার হিংস্র পশুর হাত থেকে শিশুটিকে রক্ষার জন্য এই ম্যাক্সই পনের ঘন্টা শিশুটিকে তার বুকে আগলে রেখেছিল। শিশুটিকে খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথে ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে বিস্তারিত শোনে ম্যাক্সের উপর পুলিশ খুশি হন। পুলিশ বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। সাংবাদিকরা ম্যাক্সের ছবিসহ খবরটি অস্ট্রেলিয়ার বহুল প্রচারিত ‘এবেলা’ পত্রিকায় প্রকাশ করে। প্রকাশিত সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ৬৩ হাজার লাইক এবং ১০ হাজার জন এই সংবাদটি শেয়ার করে বিশ্বকে জানিয়ে দেয় ম্যাক্সের মহত্তের গুণের বিষয়টি। এই সংবাদটি আমাদের দেশের জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকাতেও অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে।

২০১১ সালের নভেম্বর মাসে জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিলো, ‘মায়ের কোলে ওদের ঠাঁই হয় নাই।’ শিরোনামে বডিতে বলা ছিল অপকর্মের ফসল নবজাতক শিশুদের যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে। গত ১৭ নভেম্বর এমন দুটি শিশু পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে। রিপোর্টার ঢামেক এর বরাত দিয়ে বলেছিলেন; “চলতি বছরের ২৮মে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ওই দিন একটি নবজাতক শিশু উদ্ধার হয়েছে ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। দু’টি কুকুরের মহত্তের গুণে ওই শিশু বেঁচে ছিল। কে বা কারা উপজেলার হাবিরপুর চাতালের পাশে শিশুটিকে ফেলে যায়। রাতভর দুটি কুকুর এই নবজাতক শিশুকে পাহাড়া দেয়। সকালে চাতাল শ্রমিক সখিরন নেছা শিশুটিকে উদ্ধার করে। গত ২৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতা সিঙ্গেল কলামে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘বড়দের শত্র“তায় প্রাণ গেল শিশুর।’ সংবাদ বডিতে বলা হয়েছে নিখোঁজের ১৭ ঘন্টা পর বাড়ির আঙিনার মাচায় পাওয়া গেছে ৩ বছরের শিশু তামিম হোসেনের লাশ। ধারণা করা হচ্ছে, শত্র“তার জেরে এই শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে খুনিরা। আর আক্রোশ প্রকাশ করতেই হত্যার পর শিশুটির লাশ বাড়ির আঙিনায় ফেলে গেছে। নির্মম এই ঘটনাটি ঘটেছে বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার মাটিকাটা বাইপাস এলাকায়। নিহত তামিম হোসেন, নির্মান শ্রমিক রাসেল হোসেন এর ছেলে। গত ২৭ এপ্রিল একটি অনলাইন পোর্টালের একটি সংবাদে প্রকাশ ‘লাবিব নামের ৬ বছর বয়সের এক শিশুকে অপহরণের পর প্যাকেটের জুসে নেশাজাতীয় ওষুধ মিশিয়ে হত্যা করেছে অপহরণকারীরা। নিহত শিশু জামালপুর সদর উপজেলার বাঁশচড়া ইউনিয়নের ঝাউলা গোপালপুরের বন্দেবাড়ি গ্রামের ওমান প্রবাসী ইউসুফ আলীর ছেলে। ২৮ এপ্রিল অন্য একটি অনলাইন পোর্টালের একটি সংবাদ ছিলো, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যের বাজার ইউনিয়নের দাউদের গাঁও গ্রামে সৌদী প্রবাসী আনিসুর রহমানের মেয়ে ‘আনিছা’র লাশ একটি পানির ট্যাংকি থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। ‘আনিছা’ সোনারগাঁ উলুকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিশুটি ২৩ এপ্রিল প্রাইভেট পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয়। তাকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্থানে খোঁজার পর বুধবার মেয়েটির চাচা আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে থানায় জিডি করেন। শুক্রবার সকালে উলুকান্দি গ্রামের আব্দুল মালেক মিয়ার নির্মানাধীন দ্বিতীয় তলার পানির ট্যাংকি থেকে শিশুর লাশটি পুলিশ উদ্ধার করেছেন। সংবাদটিতে এই শিশু খুনের কোন ক্লু উল্লেখ নেই। আমার ধারণা এই খুনটি ধর্ষণের পর হতে পারে। ২৮ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ নাটোরের গুরুদাসপুরে ৩ বছর বয়সের ও বড়াই গ্রামের ২ বছর বয়সের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। শিশু নুসরাত ধর্ষণের পর খুন হয়েছে। ৮ বছরের পুঁজা, সাদিয়ারা মানব পশুদের হাতে জীবন দিয়েছে। এটা লেখাটি যখন তৈরি করি, তখন দেবরের সাথে ভাবীর পরকিয়ায় আগুনে পুড়িয়ে নিজ শিশু সন্তানকে হত্যার জঘন্য খবরটি চোখ এড়ায়নি। গত দুই দিনের বিভিন্ন মিডিয়ার খবর অনুযায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে ৫জন নিষ্পাপ শিশু হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতি মাসে শিশু হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ১৫০টি। বছরে ২০০০ শিশু খুন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অপ্রকাশিত এরকম হাজারো ঘটনাতো রয়েছেই। সভ্যতা-মানবতা কোথায় এসে ঠেকেছে!

সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরে আট বছর বয়সী শিশু আসিফাকে একটি মন্দিরের ভেতরে আটক করে নরপিচাশরা গণধর্ষণ করেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা ভারত ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। ভারত সরকার শিশু ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে আইন পাশ করেছে। আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগের কথা শুনেছি, ঘোড়ার পেছনে নারীদের বেঁধে ঘোড়দৌড়ের আয়োজন করে ওই সময়ের মানব পশুরা উল্লাস করতো। নারী শিশুদের আতুর ঘরেই মেরে ফেলা হতো। গোত্রে-গোত্রে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে হানাহানি, খুনো-খুনির নির্মম যুগ পেরিয়ে আমরা সভ্য যুগের পরম শিখরে বসবাস করছি। মানবতা, মনুষ্যত্ব, আইন-আদালতের এই জগতের একি হচ্ছে ! আমি ব্যক্তিগতভাবে কুকুর দেখে ভয় পেতাম, আজ তিনদিন ধরে কুকুরের উপর ভয় কেটে গেছে। ওদের আদর করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। পাশাপাশি মানুষ দেখলেই কেমন জানি মনে সন্দেহ জাগছে। তবে, ‘দ্বারবন্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।’ বাণীটি বুকে ধারণ করে সময় পার করছি। জঙ্গল ঘেরা ঐরাবত (পাগলা হাতি) যখন লোকালয়ে প্রবেশ করে তান্ডব চালায় তখনও এই হিংস্র পশুরা শিশুর গায়ে স্পর্শ করে না। আমরা দেখেছি কোন পশুই কোন পশুর বাচ্চাকে ধর্ষণ করেনি, হত্যা করেনি। অন্ধ কুকুর ম্যাক্স কিংবা ঝিনাইদহের সেই দুটি কুকুরের মহত্তের কাছে মানুষ নামের এই জানোয়ারদের কোন মূল্য আছে? কুকুররাই প্রমাণ করল তারা কুকুর নয়, মনুষ্য পশুরাই প্রমাণ করছে তারাই কুকুরের অধম। ভারতের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি ভারতের মানবতা ফুঁসে উঠতে পড়তে পারে। আমরা কেন দেশের মনুষ্য পশুদের নিষ্পাপ শিশু ধর্ষণ খুনের মহোৎসব নীরবে অবলোকন করছি। তবে কি মনুষ্য পশুর কাছে আমাদের মানবতার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে ! আমরা কি এই পশুদের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারি না ? আর উপেক্ষা-অপেক্ষা নয়, শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে সরকার, শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ একযোগে সকল মনুষ্য পশুর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো এখন সময়ের দাবী।

লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিক্ষক

মোবাইল: ০১৭১৪-২৫৪০৬৬

ই-মেইল: rahimabdurrahim@hotmail.com