নিজস্ব প্রতিবেদক:
২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, বিকাল বেলার ঘটনা। ঢাকা থেকে কক্সবাজার বাড়ীর উদ্দেশ্যে গাবতলী মেসার্স ইউকে সালসাবিল ফিলিং স্টেশন এলাকার শ্যামলী পরিবহনের সামনে পৌঁছলাম। ঠিক তখনই কালো পোষাকধারী ৭ জন লোক একটি মাইক্রোবাস নিয়ে সামনে হাজির। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকেসহ মাকে গাড়ী তুলে। মাইক্রোবাসে দুইজন মহিলাও ছিল। তারা গাড়ীতে তোলামাত্র আমাদের চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে। প্রায় ১ ঘন্টা গাড়ী চালানোর পর আমাদের একটি ছোট্ট কক্ষে নিয়ে রাখে। চোখ বাঁধা অবস্থায় খাবার দেয়া হয়। কিছুক্ষণের জন্য আমার চোখ খোলে দেয়। মাকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছিলাম। পর্দার ফাঁকে দেখি সবার গায়ে ‘র‌্যাব’ লিখা কালো পোষাক। ওখানে মাকে বেশ মারধর করা হয়। একদিন ১ রাত পর গাড়ীতে করে আমাকে কমলাপুর রেল স্টেশনের আগে একটি জায়গায় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়। সাথে ৮০০ টাকা দিয়ে বলে ‘এই টাকা নিয়ে তুই বাড়ী চলে যেও।’ বললাম, ‘মাকে ছাড়া আমি যাবনা। প্রয়োজনে আমাদের বাড়ীর সহায় সম্পদ যা আছে, সব দিয়ে দিব। তবু মাকে সাথে দেন।’ জবাব দিলো, ‘তোর মাকে ৫/৬ দিন পরে বাড়ী পৌঁছিয়ে দেব। আগে তুই চলে যা।’
এর আগে মায়ের সাথে শেষ কথা। আর কথা হয়নি। দীর্ঘ আড়াই বছর মাকে ছাড়া দিন কাটাচ্ছি। দিন যায় রাত আসে, কিন্তু মা আসেনা। জানিনা, মা-জননি বেঁচে আছে, নাকি মেরে ফেলা হয়েছে।
অশ্রুসজলে কথাগুলো বলছিল নিখোঁজ রাজিয়া বেগম রেবির কনিষ্ট মেয়ে আফসানা নুরী আলিয়া। সে কক্সবাজার জেলার উখিয়া জালিয়াপালং সোনারপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগে দশম শ্রেনীতে পড়ে। তার বাবা নুরুল কবির। আলিয়ারা ২ ভাই দুই বোন। সে সবার ছোট। বড় ভাই রেজাউল কবির জুয়েল কক্সবাজার সিটি কলেজে অনার্স (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) প্রথম বর্ষে পড়ে। বড় বোন শারমিন নুরী পাপিয়া কক্সবাজার হার্ভার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি (মানবিক) ফলপ্রার্থী। মেঝ ভাই সাজেদুল কবির সাজেল একই ক্লাসে পড়ে। দুইবার স্কুল কেবিনেট সদস্য নির্বাচিত হয় সাজেল।
দীর্ঘ আড়াই বছরের বেশী সময় ধরে মাকে না পেয়ে ৪ সহোদরের কঠিন সময় যাচ্ছে। ঠিক সময় খেতে পারেনা। স্কুলে যায়না। মাঝরাতে ভুল স্বপ্নে তাদের ঘুম ভাঙে। চারিদিকে অন্ধকার।

রেজিয়া বেগম রেবি

বড় ছেলে রেজাউল কবির জুয়েল বলেছে, যে বয়সে মা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, সে বয়সে মা থেকেও নেই। মা-শুণ্য বাড়ীতে আমাদের পড়ালেখা হচ্ছেনা। পরিবার অগুছালো হয়ে গেছে। একই অনুভূতি পাপিয়া ও সাজেলের। তারা যে কোন মূল্যে তাদের মাকে ফিরে পেতে চায়।
মা রেজিয়া বেগম রেবি (৩৯) নিখোঁজ হওয়ার পর রেজাউল কবির জুয়েল ডিএমপির দারুস সালাম থানায় ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ ডায়েরী করেছিল। নং ১১৯২।
সুত্র মতে, রেজিয়া বেগম রেবির বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তিনি দুইবার কারাগারে ছিলেন। শীর্ষস্থানীয় একজন মানবপাচারকারী হিসেবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে চিহ্নিত। তাকে ‘রেবি মেডাম’ হিসেবে সবাই চেনে। এক সময়ের বেসরকারী বীমাকর্মী রেজিয়া বেগম রেবি শুধু মানবপাচারের ঘটনা দিয়ে আলোচিত হয়ে উঠে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও স্থান লাভ করে নামটি।
তবে, মানবপাচারের অভিযোগ সত্য নয় দাবী করেন স্বামী নুরুল কবির। তিনি বলেন, প্রতিপক্ষরাই আমাদের মানবপাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমরা মানবপাচারকারী হলে কোন ভিকটিম কেন মামলা করলনা? প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করে আমাদের আসামী বানানো হয়েছে। অভিযোগ থেকে রেহায় পেতে চাই। আমাদের সুন্দর সংসার ফিরে পেতে সবার সহযোগিতা চাই।