বাংলা ট্রিবিউন :
বহুল আলোচিত ইসলামী ব্যাংককে বদলে দিতে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে এসেছিলেন সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান। দেড় বছর না যেতেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিলে বোর্ড সভায় তা গৃহীত হয়। ইসলামী ব্যাংক সূত্র বলছে, আগের চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ারকে যেভাবে অপসারণ করা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে আরাস্তু খানকেও অপসারণ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক হেলাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মঙ্গলবার ব্যাংকের বোর্ড সভায় আরাস্তু খান পদত্যাগ করলে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়। এ সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বতন্ত্র পরিচালক অধ্যাপক ড.নাজমুল হাসানকে।’

আরাস্তু খান অচিরেই অপসারণ হচ্ছেন— সম্প্রতি এমন আলোচনা চলছিল ব্যাংকিং সেক্টরে। সূত্র জানায়, গত কয়েক মাস ধরে ব্যাংকটির মালিক পক্ষের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। আবার খেলাপি ঋণ ও খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন রাখাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গেও তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির এজিএম বা সাধারণ সভা করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। একইসঙ্গে তিনি সরকারের শীর্ষ মহলেরও সমর্থন হারান।এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার (১৬ এপ্রিল) শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাকে সরে যেতে বলা হয়। পরদিনই মঙ্গলবার (১৭ এপ্রিল) তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলে বোর্ড সভায় তা গ্রহণ করা হয়। আরাস্তু খানের জায়গায় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ড. নাজমুল হাসানকে।

তবে আরাস্তু খান বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক। এখানে কাজের চাপ সামলাতে সমস্যা হচ্ছিল। এ কারণে ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি।’

এপ্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করে ব্যাংকটির একজন পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যে দূরত্ব ছিল, আরাস্তু খানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে সেটি দূর হয়েছে। একইভাবে শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ট দেওয়া নিয়ে যে জটিলতা ছিল, সেটিও দূর হয়েছে। এছাড়া, এজিএম করা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতারও অবসান হয়েছে।’ আগামী ২৫ এপ্রিলের বোর্ড সভায় এজিএমের তারিখ নির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

গত ৫ এপ্রিল ইসলামী ব্যাংকের (ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্থাপনা থেকে তিন ডিএমডিসহ শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তা বিদায় নেন। অপসারণ করা হয় অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মো. শামসুজ্জামান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এফসিএ, ডিএমডি আবদুস সাদেক ভূঁইয়া, ডিএমডি মোহাম্মদ মোহন মিয়া ও সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) আমিরুল ইসলামকে। এছাড়া, অচিরেই আরও কয়েকজনকে বিদায় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এ অবস্থায় পদত্যাগ ও অপসারণে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ব্যাংকটির শীর্ষ ম্যানেজমেন্টে ১১জন কর্মকর্তার মধ্যে পাঁচজনই পদত্যাগ করেছেন। এখন আছেন আর ছয় কর্মকর্তা। পদত্যাগ নিয়ে ইসলামী ব্যাংকে রয়েছে নানা ধরনের অভিমত।

একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড চাপ সৃষ্টি করে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এসইভিপি (সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট) ছাড়া বাকি সবার চুক্তির মেয়াদ ছিল এক বছরের। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তনের যে ধারা শুরু হয়েছিল, এটি তারই ধারাবাহিকতা।

অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েকজন কর্মকর্তা বোর্ডের সঙ্গে ভিন্নমতের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। মূলত মানসম্মান রক্ষার্থে ও জেলে যাওয়ার ভয়ে তারা স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছেন। তবে ব্যাংকটির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করে জানান, ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ভেরিফিকেশন (তদন্ত) করবে। সরকারের বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্রকারী আছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখবে। এটা শোনার পর অনেকেই পদত্যাগ করেছেন।

এর আগে আরাস্তু খানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলমকেও বিদায় নিতে হয়। সৈয়দ আহসানুল আলমকে নিয়ে গত বছরের মে মাসে আরাস্তু খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউই অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলমকে পছন্দ করছেন না।’

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৩ মে পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সৈয়দ আহসানুল হকসহ অন্য পরিচালকদের পদত্যাগ করতে চাপ দেওয়ার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। ১১ মে সৈয়দ আহসানুল আলমের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ পায়। ওই দিন তিনি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ইসলামী ব্যাংকে আবারও জামায়াত সমর্থকদের শক্তি সংহত হচ্ছে এবং তাতে সরকারের অনানুষ্ঠানিক উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে যাচ্ছে।’

এ পসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আরাস্তু খান ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই গোঁজামিল দিয়ে চালাচ্ছিলেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকের মুনাফায় ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছেন। ব্যাংককে বাঁচাতে তাকে সরানোর প্রয়োজন ছিল।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘গত একবছর ধরে ইসলামী ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা টাকা তুলে নিচ্ছিল। আবার নতুন আমানতও আসছিল না। ব্যাংকটিতে খেলাপী ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় প্রভিশনের টাকার দিতে পারছিল না। এমন নাজুক অবস্থায় আরাস্তু খানকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এটা ব্যাংকের জন্য ভালো হয়েছে।’

এদিকে মাত্র ১৬ মাসে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মুস্তাফা আনোয়ারকে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদের প্রথম সভাতেই চেয়ারম্যান করা হয়েছিল আরাস্তু খানকে। ওই সময় তৎকালীন এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নানকে সরিয়ে দিয়ে নতুন এমডি করা হয়েছিল আবদুল হামিদ মিঞাকে। তবে বয়সের কোটা পূর্ণ হওয়ায় পুনরায় নতুন এমডি করা হয় ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব উল আলমকে। অচিরেই তিনিও সরে যেতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।