রফিক আহমদ খান:

চট্টগ্রামের সন্তান হলেও জীবনে কক্সবাজার যাওয়া হয়নি আগে।এবারই প্রথম কক্সবাজার ঘুরে এলাম।
হিমছড়িতে সুউচ্চ পাহাড় চূড়ায় উঠে বিশাল সমুদ্র দেখা কক্সবাজার ভ্রমণের উল্লেখ যোগ্য একটি অংশ।কক্সবাজার কলাতলী থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে টমটমে চড়ে সমান তালে সমুদ্র আর পাহাড় হিমছড়ি যাওয়া মেলা আনন্দের।আশি কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেরিন ড্রাইভ সড়ক বাংলাদেশের প্রধানতম পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারের সৌন্দর্যে নতুন সংযোজন।দুই হাজার সতের সালের মে মাসেই দৃষ্টিনন্দন এই সড়কটি চালু হয়।এটি বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ। এই সড়ক দিয়ে যখন হিমছড়ি যাচ্ছি, মনে হচ্ছে আমি কোনো ভিন দেশে আছি।টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত সুদীর্ঘ সড়কের একপাশে সাগর আর সাগর, অন্যপাশে পাহাড় আর পাহাড়।আমার বাড়ির পাশে পাহাড় থেকেও সমুদ্র দেখা যায়।তবে তা হিমছড়ি পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখার সাথে কোনো তুলনা হয় না।এখানে বঙ্গোপসাগরের পরিষ্কার জলরাশি খুব কাছ থেকে হাতছানি দেয়।পাহাড়ের চূড়া থেকে, সড়কের পাশ থেকে বা সৈকতে দাঁড়িয়ে যেখান থেকে ইচ্ছে সমুদ্র দেখা যায়।যেখান থেকে যেভাবে দেখি, সারাদিন দেখলেও যথেষ্ট হওয়ার নয়।আরো দেখতে মন চাই।কোনো বিরক্তবোধ নেই।উঁচু পাহাড় থেকে সমুদ্রের গর্জন শুনেও ভাল লেগেছে।
হিমছড়ি পাহাড়ে উঠার জন্য টাকা নিলেও সিঁড়ি গুলো বানানো হয়েছে খুবই ছোট।নারী ও শিশুরা উঠা কষ্টসাধ্য। অবশ্যই এই পাহাড়ে উঠা শিশুদের জন্য ছোটখাটো একটা এডভেঞ্চারও বটে।
পাহাড়ে উঠে আপন মনে অধিক সময় নিয়ে সমুদ্র দেখা হয়নি সময় সল্পতার কারণে।এটা যেনো আবারও কক্সবাজার যাওয়ার বীজ বপন করা রইল মনে।শুধু কী পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখা!সৈকতে পাতানো কোনো একটি চেয়ারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে খুব কাছ থেকে মন ভরে সমুদ্র দেখাও হয়নি।সবচেয়ে ভাল লেগেছে আমাদের পাঁচ বছর বয়সী জাওয়াদ ও নয় বছর বয়সী মায়িশার সমুদ্রের জলে বাঁধনহারা ছোটাছুটি।ওরা পা ভেজাতে ভেজাতে কোন দিকে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলল।প্যান্ট ভেজাতে ভেজাতে গায়ের জামা।এরপর তো ঢেউয়ের তালে তালে জলের সাথে গড়াগড়ি আর ডুব।চালু চরে দাঁড়িয়ে ওদের মা ও তুষার বাবুর চিল্লাচিল্লি ওরা কানেও নেয়নি।আমি তো শুধু উপভোগ করেছি শিশুদের এই খুশির উৎসব।
দরিয়া নগর বীচে গিয়ে শিশুদেরকে প্যারাসুট দেখাও হয়ে গেলো।টমটমে টুকটাক টুকটাক করে পথ চলতে চলতে সাগরপানে হঠাৎ প্যারাসুট চোখে পরাতে নেমে পরলাম টমটম থামিয়ে।শিশুরা দেখলো বীচ থেকে প্যারাসুটে উঠে যাচ্ছে একটা মানুষ।দেখতে দেখতে মানুষটিকে দেখাচ্ছিল পাখির মতো।কী আনন্দ মায়িশা ও জাওয়াদের।ওদের মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কক্সবাজারে তোমার কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে? ছটফট উত্তর – দরিয়া নগর বীচে ছায়াশীতল ঝাউ গাছের নিচে রাস্তার ধারে পাথরে বসে বসে প্যারাসুট দেখা।আর লাবনী বীচে পানির খুব নিকটে চেয়ারে বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখে দেখে বাদাম ও ঝালমুড়ি খাওয়া।
বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টের ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে।নাম গুলোও ভীষণ শ্রুতিমধুর।আমরা যে বীচ গুলোতে গিয়ে অসীম সমুদ্র দেখেছি সে গুলো হচ্ছে লাবনী বীচ,সুগন্ধা বীচ, কলাতলী বীচ, দরিয়া নগর বীচ, হিমছড়ি বীচ ও ইনানী বীচ।প্রত্যকটা বীচের সৌন্দর্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।এই যেমন সুগন্ধা বীচে বালু চরের সাথে সারি সারি ঝাউ গাছ আর কলাতলী বীচের পাশে সুউচ্চ অট্টালিকা। হিমছড়ি ও দরিয়া নগর বীচে বালুচরের ওপারে পাহাড় আর পাহাড়।ইনানী বীচে বড় বড় পাথর আছে, যা কলাতলী,সুগন্ধ্যা ও লাবনী বীচে নেই।
কক্সবাজার ঘুরতে আসা দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের জন্য কলাতলী রোডে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি অসংখ্য হোটেল।এছাড়া পুরো শহরে গড়ে উঠেছে অগণিত হোটেল-রিসোর্ট।বিভিন্ন মানের বিশাল বিশাল কিছু হোটেল দেখে সত্যিই মনে হয়েছে কোন দেশে এলাম।এটি বাংলাদেশ নাকি পৃথিবীর অন্য কোনো উন্নত শহর।এতো পর্যটক এতো হোটেল-রিসোর্ট তারপরও পুরো শহরটি অনেক খোলামেলা।নিঃশ্বাস ফেলার যথেষ্ট জায়গা আছে। যা ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরে নেই।চমৎকার দালানে গড়া হোটেল গুলো দেখে যে কারো ভাল লাগার কথা।হিমছড়ি যাওয়ার দীর্ঘ পথেও গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন অনেক রিসোর্ট।
অত্যন্ত খোলামেলা কক্সবাজার শহরে টমটমে চড়ে ঘুরতেও ভালো লেগেছে।পর্যটন শহর হিসেবে শহরটি আরো বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছি গভীরভাবে।পুরো শহর যত বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে বিদেশি পর্যটকরা তত বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে বেড়াতে।শহরে চারিপাশ চকচকে রাখার প্রতি আরো অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য।বিদেশি পর্যটক বাড়লেই তো কক্সবাজারের রূপের কথা আরো বেশি ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি ভ্রমণবিলাসী মানুষের কাছে।
কক্সবাজার যাওয়া-আসার সময় সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করেছি অপ্রশস্ত সড়কের কথা।বারবার মনে হয়েছে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য গাড়ি আছে, রাস্তা নেই।কর্ণফুলী সেতুর পর ক্রসিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কটি চার লেনে রূপান্তর করা খুবই জরুরি।
কক্সবাজার শহরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মার্কেট রয়েছে, যার প্রায় সব গুলো ‘বার্মিজ মার্কেট’ নামে পরিচিত।এ সব মার্কেটের প্রধান আকর্ষণ ‘আচার’।আমরাও বিভিন্ন রকমের অনেক গুলো আচার কিনেছি।সাথে কয়েক রকমের শুটকি।কক্সবাজারে শুটকির দোকান গুলোর আলাদা বিশেষত্ব আছে।কেউ কেউ আছেন শুটকির গন্ধ পছন্দ করেন না।আপনার সাথে বেড়াতে আসা এমন কেউ থাকলেও তাকে নিয়ে বিনা দ্বিধায় শুটকির দোকানে যেতে পারেন, আপনার প্রিয় শুটকি কেনার জন্য।কারণ, কক্সবাজারে শুটকির দোকানে তেমন কোন গন্ধ নেই।দোকানের সব গুলো শুটকি সাদা পলিথিনে আলাদা আলাদা মোড়ক করানো।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শুটকির দোকান গুলি। শুটকিপ্রিয় মানুষ সেখান থেকে শুটকি না কিনে ফিরে আসতে পারবে না।খুব গোছানো চকচকে সুন্দর একটি শুটকির দোকান দেখে তো আমার স্ত্রী ও ছোট ভাই তুষারকে ডেকে দেখালাম, দেখ তো, এটা শুটকির দোকান নাকি স্বর্ণের দোকান! এমন সুন্দর শুটকির দোকান থেকে শুটকি কিনেই বেরিয়েছি।
কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তা বন্ধু মিজানুর রহমানের আতিথেয়তা ও কক্সবাজার টেকপাড়ায় শ্বশুর বাড়ির পক্ষের আত্মীয়ের কাছে থেকে জামাই আদরও জুটেছে।কক্সবাজার স্থানীয় মানুষের নিজস্ব রেসিপিও খাওয়া হয়েছে।কক্সবাজারে যাদের ঘরে খেয়েছি, তারা পুকুরের মাছ খুব কম খায়, সমুদ্রের মাছ-ই প্রধান পছন্দের।তাদের কাঁচামরিচের তরকারি যেটা খুব ঝাল হয়েছে সেটা খেয়েও আমাদের শিশুরা ঝালের জন্য উহ! উহ!! করেছে।যদিও আমার মজা লেগেছে। আসলে কক্সবাজার ভ্রমণের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।আর একবার মাত্র কক্সবাজার গিয়ে কক্সবাজার দেখা সম্পূর্ণ হয় না।আমারও হয়নি।আবারও যেতে হবে কক্সবাজার। বারবার যেতে হবে। সৈকতের বালু চরে পাতানো চেয়ারে শুয়ে বঙ্গোপসাগরের বিশালতা দেখতে হবে মন ভরে।দেখতে হবে উৎসাহী পর্যটকদের সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে গড়াগড়ি ও শিশুদের বাঁধনহারা খুশি।