বিদেশ ডেস্ক:
পোরেশনের (আরসিবিসি) বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। তবে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে আইনি পথে আত্মসাৎ হওয়া অর্থ উদ্ধারে সফলতা পাওয়ার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। আইন ও ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, মামলা করে টাকা ফিরে পাওয়া কঠিন। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মসাৎ হওয়া অর্থ উদ্ধারে সমঝোতামূলক বিকল্প পথ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। নিজস্ব অনুসন্ধাসসূত্রে তাদের দাবি,মামলা নিষ্পত্তির এক মাস আগে ইকুয়েডরের একটি ব্যাংক ও মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফার্গোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ার একটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-পরিচালক সরাসরি এ কথা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানালেও নিশ্চিত করেছেন, সম্ভাব্য বিভিন্ন বিকল্প পথের মধ্যে ফিলিইনের ঘটনাটিও তাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। আইন ও ব্যাংক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা রয়টার্সকে বলেছেন, ইকুয়েডরের ব্যাংকের সঙ্গে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সমঝোতার ঘটনা বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলে হ্যাকাররা। নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট থেকে হাতিয়ে নেয় ৮১ মিলিয়নেরও বেশি অর্থ। সুইফট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হ্যাকাররা ওই অর্থ ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে (আরসিবিসি) নিজেদের হিসাবে পাচার করে নেয়। ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে খোলা ওই হিসাবগুলো থেকে বেশিরভাগ অর্থ ম্যানিলার ক্যাসিনোর জুয়ার আসরে চলে যায়। এর ক্ষুদ্র একটা অংশ উদ্ধার হলেও এখনও ৬৬ মিলিয়ন ডলারের কোনও হদিস পায়নি বাংলাদেশ।
নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির সময় হ্যাকারদের কাছ থেকে পাওয়া পেমেন্ট মেসেজ এসেছিল সুইফট কোডে। চুরির পর বাংলাদেশ নিউ ইয়র্ক ফেডারেল ব্যাংক ও সুইফটের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিল। তবে পরে প্রতিষ্ঠান দুটি বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ ফেরত পেতে সহযোগিতার আশ্বাস দিলে সম্পর্ক উষ্ণ হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যাংকিং চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তিতে প্রত্যেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইট প্রোটেকলে আস্থাশীল বলে স্বীকার করে নেয়। আর সুইফট ব্যবহার করে ওই অর্থের বেশিরভাগ অংশ আরসিবিসিকে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। ববাংলাদেশ এখন আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলার পদক্ষেপ নিচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ ফেরত পেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তিনি রয়টার্সকে বলেছিলেন, এটা নিশ্চিত যে, আমরা মামলা করবো। বাংলাদেশে এটা নিয়ে হতাশা আছে। তবে একসাথে আমরা সবাই মিলে এখন ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছি।
সাইবার আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির অর্থ উদ্ধারের সুযোগ কতোটুকু; তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক মার্কিন আইন নিউ ইয়র্ক ইউনিফর্ম কমার্শিয়াল কোড-এর এ সংক্রান্ত অবস্থান সামনে এনেছে রয়টার্স। সেখানে বলা রয়েছে,, কোনও ব্যাংকে চুরির মতো প্রতারণার দায় ততোক্ষণ পর্যন্ত সেবা গ্রহীতার যতোক্ষণ না তারা প্রমাণ করতে পারছে অর্থ ছাড় করা সংক্রান্ত বার্তা যাচাইয়ে, তাদের মধ্যে সম্মতিসূচক কোনও চুক্তি আছে। তেমন চুক্তি থাকলেই কেবল এই কোডের আওতায় গ্রহীতার বলার সুযোগ থাকত যে নিরাপত্তা চুক্তিটি বাণিজ্যিকভাবে তাদের জন্য ন্যায্য হয়নি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে আরসিবিসির তেমন কোনও চুক্তি ছিল বলে এ পর্যন্ত জানা যায়নি।
আন্তর্জাতিক তদন্ত সত্ত্বেও এই চুরির জন্য এখনও সুইফট নেটওয়ার্ক আর আরসিবিসির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মামলা দেওয়া হলেও সুফল পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে রয়টার্সের কাছে সংশয় প্রকাশ করেছেন আইন ও অর্থ বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ আরসিবিসিকে মামলার হুমকি দিলেও ম্যানিলাভিত্তিক ওই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান দাবি করছে, , বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলার বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাদের ‘শক্ত আর বৈধ’ অবস্থান প্রমাণের সুযোগ রয়েছে। মার্কিন আইনজীবীদের কাছ থেকে পাওয়া পরামর্শে তারা এ কথা জেনেছেন। সোমবার এক বিবৃতিতে ফিলিপাইনের ব্যাংকটি বলেছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া অর্থের জন্য আরসিবিসির বিচার করার মতো কোনও আইন নেই। আমরা আবারও বলছি, আরসিবিসি কেবল আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন ও স্থানান্তরে ব্যবহৃত একটি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ ছাড় হয়েছিল হ্যাকিংয়ের ফলাফল হিসেবে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আইনি প্রতিষ্ঠান ফ্রেশফিল্ডস ব্রুকহাউসের সিনিয়র এসোসিয়েটস পিটার জেফও মনে করছেন, ’সাইবার আইনে এই মামলার ইতিবাচক রায় পাওয়া কঠিন হবে। তিনি বলেছেন, আরসিবিসি নিজে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়নি। এখানকান কোনও একাউন্টের মাধ্যমে অর্থ এলে তার [যাচাইবাছাইয়ে] অন্য পথ নেওয়ার বিষয় থাকতে পারে। তবে আসলে সেটা কোনও সাইবার নিরাপত্তার ইস্যু নয়। আমি মনে করি না, সাইবার নিরাপত্তার আইন অনুসরণ করে আপনি কিছু করতে পারবেন।
মামলার হুমকি দিলেও রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও আইনি উদ্যোগ নেয়নি বাংলাদেশ। রয়টার্সের বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইনি উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে এসে সমঝোতার খবর দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে ব্যাংকো দেল আস্ত্রোর হিসাব থেকে সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ১২ মিলিয়ন অর্থ চুরি যায়। মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফার্গোর কাছে এই ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করে তারা। এই লেনদেন অনুমোদনের দায়িত্ব ছিল মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির। জালিয়াতির মাধ্যমে লেনদেনের অনুরোধ পাঠানো হলেও তা আটকাতে ব্যর্থ হয় ওয়েলস ফার্গো। বিচার শুরু হওয়ার নির্ধারিত তারিখের একমাসেরও কম সময় আগে এই মামলা আদালতের বাইরে সমঝোতা করে নেয় প্রতিষ্ঠান দুটি। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের জেলা আদালতের নথি অনুযায়ী গত ফেব্রুয়ারিতে এই বিষয়ে সব আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রয়টার্স বলছে সে সময় মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই সমঝোতার খবর আসেনি। সমঝোতার বিষয়ে ওয়েলস ফার্গো কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। আর তাৎক্ষণিকভাবে এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ব্যাংকো দেল আস্ত্রোর কাছে পৌঁছাতে পারেনি রয়টার্স।
চুরি হওয়া রিভার্জ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা হাসান মো. রাজির সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকার উদ্ধৃত করেছে রয়টার্স। অর্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা সম্পর্কে সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘এটা একটা কৌশলের প্রশ্ন । আমরা আমাদের কৌশল উন্মুক্ত করবো না। তকে হ্যা আমরা ইকুয়েডরেরটিসহ প্রত্যেকটি মামলা পর্যালোচনা করে দেখছি।’ মার্কিন আইনজীবীরা বলছেন, আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলা করলে শুনানির তারিখ পেতে এবং কার্যকর ফলাফল নিশ্চিতে বেগ পেতে হতে পারে বাংলাদেশকে। রয়টার্সকে তারা বলেছেন, ব্যাংকো এবং ওয়েলস ফার্গোর ঘটনায় সমঝোতার মধ্য দিয়ে বোঝা যায় ওয়েলস হয়তো কোনও না কোনওভাবে ব্যাংকোকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এখান থেকে বাংলাদেশ বিকল্প খুঁজতে পারে। বাংলাদেশের জন্য তা উৎসাহব্যঞ্জক হতে পারে। পিটার জেফ বলেছেন, ‘সব ধরনের আইন (তা প্রয়োগ করা হোক আর না হোক) থাকা সত্ত্বেও সমঝোতার মধ্য দিয়ে সংকট নিরসনের বহু কারণ রয়েছে’।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।