মোঃ নাজমুল সাঈদ সোহেল, চকরিয়া:
কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সম্পদ ভান্ডার হিসেবে খ্যাত চকরিয়া-পেকুয়ার উপকূলে লবন শিল্প। সারাদেশের চাহিদা মেটাতে প্রচন্ড গরম ও রোদে পুড়ে আমাদের চাষীরা লবণ উৎপাদন করলেও কুচক্রীদের আমদানীর কারনে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত তৃণমূলের কৃষকেরা। ঢাকা -নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-খুলনার মিল মালিকরা লাখো লবন চাষীর ভাগ্য নিয়ে আবারো ছিনিমিনি খেলায় মেতে উঠেছেন বলে অনেকটা কৃষকের মাঝে রব সৃষ্টি হয়েছে।

সূত্র মতে, দেশের বৃহত্তম লবণ উৎপাদন জোন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ মোট ৬৯ হাজার ৪১৫ একর জমিতে প্রায় ৪০ হাজার চাষী চলতি মৌসুমে লবন চাষ করছে। জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। দেশের এক তৃতীয়াংশ লবণের চাহিদা পুরণ করে চকরিয়া তথা কক্সবাজারের উৎপাদিত লবণ।বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে গত মৌসুম  লবণের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকায় দেশের একমাত্র লবন উৎপাদনকারী জেলা কক্সবাজারের প্রান্তিক বেশিরভাগ চাষীরা লাভের আশায় এমৌসুমে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কৃষকেরা মাঠে নেমেছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় চলতি উৎপাদন মৌসুমে প্রচুর পরিমান লবন উৎপাদন হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমান লবন। তবে এবার লবণের মূল্য কম থাকায় চাষীদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। জানুয়ারী মাস থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়ে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে।এতদাঞ্চলে দুই ধরনের পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়।

লবণ উৎপাদনে সনাতন পদ্ধতি কালো লবণ, অপরটি পলিথিন পদ্ধতিতে সাদা লবণ। পলিথিন পদ্ধতিতে চাষীরা লাভবান হওয়ায় এখন দিন দিন পলিথিন পদ্ধতির চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে কালো লবণের দাম মণপ্রতি প্রায় ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, সাদা লবণ ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ দাম অব্যাহত থাকলে চাষীরা হোঁচট খাবেন। বিশাল লবণ উৎপাদন জোন চকরিয়া-পেকুয়ায় হাজার হাজার একর লবণ মাঠ।এসব জমিতে চলতি বছর চাষিরা লবণ উৎপাদনে অনেকটা ভোগান্তির শিকার হয়েছে।

কথা হলে,   লবণ চাষিরা চেহারা মলিন করে জবাব দেন- উৎপাদন ভাল হচ্ছে, তবে কাঙ্খিত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে প্রতি কানি জমি ৩০ হাজার টাকার উপরে লাগিয়ত চলছে যা আগে ৮-১০ হাজার টাকা বেশি কখনই যেত না। তবে গত ২/৩ বছরে লবণের বেশ ভাল দাম পাওয়ার কারনে সবার ভেতরে এখন লবণ চাষে আগ্রহ বেড়েছে। আগে ১০/১২ কানি জমিতে লবণ চাষ করতাম এখন আরো ১০ কানির মত বর্গা নিয়েছি প্রতি কানি ৩২ হাজার টাকা দরে।সে অনুযায়ী আমার ইনভেস্ট প্রায় ১০ লাখ টাকা।বর্তমান পরিস্থিতিতে একমন লবণ বিক্রি করে ৩ কেজি চালও ক্রয় করা যাচ্ছেনা। পরিবার পরিজন নিয়ে তারা খুব একটা শান্তিতে নেই।

তথ্য মতে, মাঠ পর্যায়ে চাষিরা ৪৩/৪৫ কেজি লবণ বিক্রি করে মূল্য পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ টাকা। প্রতি কেজির মূল্য দাড়ায় সাড়ে ৫ টাকা। অথচ কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদিত লবণ ক্রয় করে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো প্রতি কেজি প্যাকেট জাত লবণ বিক্রি করছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ৮টি উপজেলার উৎপাদিত লবণ নিয়ে দেশের লবণের চাহিদা মিটানো হচ্ছে। প্রাকৃতিক বৈরী আচরণের কারণে গত বছর লবণ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় অজুহাত দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানী করেছে বেশির ভাগ মিল মালিক। তাদের গুদামে এসব বিদেশী লবণ এখনো মওজুদ আছে। ফলে দেশে উৎপাদিত লবণ কিনতে তারা তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেনা। মাঠ পর্যায়ে কিছু ব্যবসায়ী লবণ ক্রয় করে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে নিয়ে গেলেও ১ লক্ষ টাকার লবণ বিক্রি করে পাচ্ছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। বাকী টাকা পরে দেয়া হবে বলে আশ্বাসের বাণী শুনানো হচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে দরিদ্র চাষিরা উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে না পেরে লবণ উৎপাদন করতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো আয়োডিন মিশ্রিত লবণের নাম দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করলেও সরাসরি লবণ উৎপাদন কাজে জড়িত চাষিদের পেটে ঠিকমত মোটাচালের দু’ বেলা ভাতও জোটছে না। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এসব প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীগুলো শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও লবণ চাষিরা কোন ধরণের ব্যাংক ঋণ পায়না বললেই চলে। আগামী মাস পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকলে দেখা যাবে, ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে। কিন্তু প্রাকৃতিক দূর্যোগ হলেই ওইসব প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো লবণ উৎপাদনের ঘাটতি দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির তোড় জোড় শুরু করবে। বিদেশ থেকে লবণ আমদানী করলেই মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবণ মাঠের গর্তেই পড়ে থাকে। গত বছর লবণের বাজার মূল্য ভাল ছিল বলে বেশিরভাগ চাষি লাভের আশায় ব্যাপক লবণ চাষ করেছে।

কক্সবাজার বিসিক কর্মকর্তা মোঃ শামীম আলম জানায়, জেলার ৮ উপজেলার উপকুলীয় এলাকায় পলিথিন পদ্ধতিতে চাষীদের মনোযোগী করতে পারলে উৎপাদন আরো বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয় চলতি মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম সন্তোষ জনক না থাকায় চাষীদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

লবণ চাষীরা জানায়, বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম কম। লবণ চাষীদের পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ চাষ করার জন্য আরো উদ্বুদ্ধ করতে পারলে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের হার আরো বেড়ে যাবে। তাতে করে দেশে লবণের চাহিদা পুরণ করে বিদেশে রপ্তানী করা যাবে।

ইসলামপুর লবণ মিল মালিকরা জানান, দেশের একটি মুনাফালোভী চক্র প্রতিবছর সিন্ডিকেট করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির অশুভ পাঁয়তারা করে থাকে। যা দেশের লবণ শিল্পে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। যদি নানা অজুহাতে লবণ আমদানি করা হয় তা হলে লবণের ন্যার্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হবেন।লবণ চাষীদের দাবী অবিলম্বে কক্সবাজারে স্থায়ী লবণ বোর্ড গঠন করে মাঠ পর্যায়ে লবণের মূল্য নির্ধারণ, প্রান্তিক লবণ চাষীদের সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণদান ও বিদেশ থেকে লবণ আমদানী পারমিট বন্ধ করে দেশীয় লবণ শিল্পকে রক্ষা করতে হবে। প্রান্তিক লবন চাষীরা দেশের অর্থনীতি ও লবণ শিল্পকে ধংসের হাত থেকে বাঁচাতে অবিলম্বে মাঠ পর্যায়ে সরকারীভাবে লবন ক্রয়ের ব্যবস্থা করে লবণের ন্যায্য মুল্য নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবী জানন।

কক্সবাজার লবন বোর্ডের সভাপতি মোস্তফা কামালের মাধ্যমে জানা যায় , বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন কিছুকাল আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, শিল্পের জন্য ৭৫ হাজার টন ও ভোজ্যলবণ ৭৫ হাজার টন আমদানি অনুমতির সুপারিশ রয়েছে। এতদিন স্থানীয় শিল্প সুরক্ষার জন্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, বাজারে দাম নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে। এখনও পর্যাপ্ত লবণ মজুদ রয়েছে। এর পরে আরও বাড়তি লবণের চাহিদা সৃষ্টি হলে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।বর্তমানে ভোজ্যলবন আমদানি নিষিদ্ধ রয়েছে।উৎপাদন ঘাটতি হলে ‘কেইস টু কেইস’ ভিত্তিতে অনুমতি দেওয়া হয়। তাছাড়া সারা বছর প্রয়োজন অনুযায়ী শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল হিসেবে লবণ আমদানির অনুমতি দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। এবার ১৮লাখ টন চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে দেড় লাখ টন ঘাটতি সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য এ পরিমাণ আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ লবন চাষী সমিতির সদস্য দর্বেশকাটার ফয়জুল ইসলাম বলেন, এমতাবস্হায় লবন আমদানী হলে চকরিয়া তথা কক্সবাজারের লবন শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে।

কক্সবাজার লবন শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আবছার উদ্দীন আহমদ জানান, জেলার উপকূলীয় এলাকায় গত মৌসুমে ১৫ লাখ ৫৫ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, সরবরাহ পর্যায়ে এবং বাজারেও আড়াই লাখ টন লবন মজুদ রয়েছে চলতি উৎপাদন মৌসুমের আগ পর্যন্ত। মজুদসহ চলতি এমৌসুমের লবন দিয়ে চাহিদা মেটানো যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

লবন চাষীরা আরো জানান, ঢাকা-খুলনা-চাঁদপুর-নারায়নগঞ্জকেন্দ্রীক মিল মালিকদের অসাধু সংগঠন প্রতিবছর লবন আমদানী করার চেষ্টায় থাকে। উল্লেখ্য, নারায়নগঞ্জের কুখ্যাত পরিতোষ সাহার নেতৃত্বাধীন এ সিন্ডিকেট এর আগেও লবন আমদানীর জন্য দৌঁড়ঝাপ শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে গত বছর এপ্রিল মাসে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল কক্সবাজার সফরে এসে জেলা প্রশাসক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও চাষীদের সাথে মতবিনিময় করেছিলেন।

জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারন সম্পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান এবং কক্সবাজারের মিল মালিকরা দেশীয় লবন শিল্প রক্ষায় আমদানীর বিরোধীতা করেন। এতে লবন আমদানীর চক্রান্ত ভেস্তে যায়। কিন্তু এখন আবারো আমদানী করার জন্য আগের সেই সিন্ডিকেট মাঠে নেমেছে। লবনের আশানুরূপ দাম থাকায় চলতি মৌসুমে চাষ করার জন্য উচ্চমূল্যে লবন মাঠ লাগিয়ত নিয়েছেন চাষীরা। এমতাবস্হায় আমদানীজনিত কারনে দরপতনের ফলে প্রান্তিক চাষীরা চরম ক্ষতির সন্মুখীনের মুখাপেক্ষী হতে যাচ্ছেন।