জেড করিম জিয়া, টেকনাফ:
বিভিন্ন সভা সেমিনারে শিশুদের অধিকার নিয়ে জোর গলায় হয়তো বলবেন ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত’। কিন্তু শ্লোগানটি এখনও বই পুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধই থেকে গেছে। টেকনাফে হাটবাজার ঘুরলে এর বাস্তব চিত্র সহজেই চোখে পড়ে।সরকারীভাবে ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে আয়োজন করে পালন করা হলেও ভাল নেই টেকনাফের সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা।টেকনাফে শিশুর উন্নত ভবিষ্যত গড়তে সরকারের কার্যকরী কোন উদ্যোগ যেমন চোখে পড়েনা, বেসরকারী পর্যায়েও নেই তেমন কোন কার্যকরী ভূমিকা! হয়তো ছোট বেলায় উৎসাহ নিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেও জীবিন-জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে কদিন পড়েই তাদের বেছে নিতে হয় অর্থ উপার্জনের পেশা। তাই টেকনাফ উপজেলা জুড়ে শিশু ও কিশোর শ্রমিকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। অথচ শিশু শ্রম প্রতিরোধে সরকারী, বেসরকারী সংস্থা ও এনজিওগুলোর এখানে উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা নাই বললেই চলে ।
বিভিন্ন সূত্র ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা জানান, শিশুদের নিয়ে প্রথম আইন তৈরী হয় ১৯২৩ সালে। অতঃপর ১৯৩৪ সালে জেনেভা ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব দ্যা চাইলড তৈরী করা হয়। তাতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-শিশুরা যাতে কোন ধরনের ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে রাষ্ট্র সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে। এরপর ১৯৫৯ সালে ডিক্লারেশন অব দ্যা রাইটস অব দ্যাচা নামে নতুন আরেকটি আইন তৈরি করা হয়। যার মূলকথা-ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, রাজনীতি, সকল বৈষম্যের উর্ধ্বে থাকবে শিশু-কিশোররা।
পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার আইন নামে আরেকটি আইন তৈরী হয়। এতে ১ থেকে ৫৪ ধারা পর্যন্ত বিভিন্ন ধারায় শিশুদের অধিকার নিয়ে পরিস্কার বলা আছে। তবে এই আইনের মূল কথা হলো-শিশুরা যাতে সকল ধরনের বৈষম্য ও যন্ত্রণার উর্ধ্বে থাকেনা, রাষ্ট্র এমন কোন কাজ করবেনা। একই সাথে আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র শিশুদেরকে পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য থাকবে। এমনকি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যদি কখনও বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, তাহলে তাদের সন্তান যাতে সকল রকম সুযোগ সুবিধা পায় আদালত এবং প্রশাসন তার স¤পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করবে।
টেকনাফ বাস ষ্টেশনে ওয়ার্কশপে ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু রফিককে জাতীয় শিশু দিবস সর্ম্পকে জিজ্ঞেস করলে সে অবাক পানে তাকিয়ে থাকে। যেন এধরনের কথা আগে শুনেনি।
সে জানায়, সবাই শিশুশ্রম ও অধিকারের কথা বলে, কিন্তু কাজ বা পরিশ্রম না করলে কিভাবে আমাদের ঘরের চুলা জ্বলবে তা কেউ ভেবে দেখে না। আমরা যারা অবহেলিত, তারা অবহেলিত থেকে যাব। আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আন্তর্জাতিক আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য হলেও টেকনাফে সে আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। এখানে দোকান মালিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ সমাজের উঁচুস্তরের অনেকেই শিশুদের শ্রমিক হিসেবে খাটান।
বিভিন্ন হাট-বাজারে এসব শিশু শ্রমিকের একটি বড় অংশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এদের অনেকেই মাইক্রোবাসের হেলপার; কেউবা চালাচ্ছে রিকশা, কেউ কাঠমিস্ত্রি-রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাঠোর পরিশ্রম করছে।
কিছুসংখ্যক শিশু মুদিদোকান আর হোটেল-রেস্তোরাঁয় অবিরাম পরিশ্রম করছে। কিন্তু দিনশেষে বা মাস শেষে পারিশ্রমিক হিসেবে যা পাচ্ছে, তা খুবই সামান্য। এসব শিশুর অধিকাংশই পিতৃমাতৃহীন। অনেকে আবার বাবা কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত অসহায় মায়ের বোঝা। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ঝি-এর কাজেও অনেকে নিয়োজিত। আছে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রের হকার, কুলি-মজুর আর মোটরগাড়ি মেরামত কারখানার শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। তারা কাজের বিপরীতে পারিশ্রমিক পান খুবেই নগণ্য।
মালিকদের মনের মত কাজ না হলে এসব শিশু শ্রমিকের ভাগ্যে জোটে নির্যাতন। অথচ যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে তাদেরকে ধরতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে সংসারের হাল। আর এই হাল ধরতে গিয়ে বিভিন্ন রকম ঝুঁকিপূর্ন কাজে নিয়োজিত হচ্ছে এসব শিশুরা।
এমনকি ওয়েল্ডিং বা ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ওয়ার্কশপে কাজ করছে ওরা। এতে করে তাদের শুধু শারীরিক ক্ষতিই হচ্ছেনা, বরং মানষিক ভাবেও দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং ঝুঁকিপূর্ন এসব কাজ করতে গিয়ে নানারকম দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তারা। আর এতে বিভিন্ন রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্বসহ প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সোনালী ভবিষ্যত।
প্রতিদিন কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এরা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক যেমন পায় না, তেমনি সামান্য ত্র“টিতেই মালিকপক্ষ শারীরিক নির্যাতনসহ গুনতে হয় জরিমানা। শাররীক নির্যাতনের পরেও পারিবারিক বোঝা কাঁেধ নিয়ে অল্প বয়সেই ঝুঁকিপূর্ণ সব কাজে যাচ্ছে এবং অস্বাভাবিক পরিশ্রম করে এরা যেন কঙ্কালের রূপ ধারণ করছে ।
টেকনাফে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা এলাকায় থাকলেও এসব শিশুদের পূর্নবাসনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভূমিকায় চোখে পড়ছে না। তাই টেকনাফের সচেতন মহল মনে করেন, শুধু সভা-সেমিনারে শিশু অধিকার, শিশুশ্রম, শিশু দিবস নিয়ে গলাবাজি না করে এসব সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের পূর্নবাসনে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহবান জানান