হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী :
একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের একটি ছেলে। জেএসসিতে ২.৭৯ আর এসএসসিতে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে জিপিএ ৩.৬১ মানে মাঝারি ধরণের ফলাফল। পরে নিজের ইউনিয়নের কাছাকাছি একটা মোটামুটি মানের ভিন্ন উপজেলার কলেজে ভর্তি হয়ে
গেল। ওর অনেক সহপাঠিই ছোটবেলা থেকে ঠিকমতো শিক্ষক পেয়েছে, কোচিংয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সচেতন বাবা মা’র সন্তান বলে পড়াশোনা কীভাবে করতে হয় সেটাও জানতে পেরেছে আগে থেকেই। অথচ ছেলেটা এতকিছু স্বপ্নেও ভাবেনি। কখনো কারোর ছে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য কিংবা সুযোগ কোনটাই তার ছিল না। প্রথম  শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেটি পেছনের বেঞ্চের ছাত্র ছিল। শ্রেণির রোল নম্বরও থাকতো অনেক দূরে। কলেজে যাওয়ার পর লেখাপড়ায় তার আগ্রহ বাড়ে।

কলেজের ক্লাসে একদিন এক স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা কী করেন?” ও গর্বের সাথে উত্তর দিল, “কৃষিকাজ করেন।” সেই স্যার তখন তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে কৃষক?” ছেলেটা বলল, “জ্বি স্যার।”
“তাহলে উনি তো নিশ্চয়ই পড়াশোনা জানেন না। তাহলে, তোমাকে বাড়িতে কে পড়ায়?” এসব শুনে ওর সহপাঠিরা হাসাহাসি করছিল। অনেক কষ্টে কান্না চেপে “স্যার, আমি নিজেই পড়ি, আমার বড় ভাই সবসময়ই আমাকে উৎসাহ দেন।” এইটুকু বলেই ছেলেটা বসে পড়লো।

এই গল্প কক্সবাজারের রামুর গর্জনিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত থোয়াংগেরকাটা গ্রামের ঘোনারপাড়ার দরিদ্র শিক্ষার্থী রবিউল আলম ওরফে রবির। সে অনেকটা অচেনা। শিক্ষকেরাও তাকে ভালমত চিনতেন ন। তবে চলতি বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিভাগে সফলতার সাথে কৃতকার্জ হয়ে রবিউল এখন আলোচনায়।

সম্প্রতি রবিউল আলাপকালে প্রতিবেদক হাফিজুল ইসলাম চৌধুরীকে বলেন, ‘আমি স্বপ্নেও ভাবিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাব। আসলে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক জীবনে লেখাপড়া উপভোগ করিনি। উচ্চমাধ্যমিককে গিয়ে চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বড় ভাই মনিরুল আলমের উৎসাহে অনেক পরিশ্রম করেছি। এ কারণে এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৩৩ অর্জন। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে সুযোগ পাওয়া। রীতিমত তা আমার কাছে এখনো স্বপ্ন মনে হয়।’

রবিউল বললেন, গ্রামের ঘোনারপাড়া ব্রাক স্কুলে পড়ে ভর্তি হয়েছিলেন গর্জনিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে। কিন্তু ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত তার রোল ছিল চল্লিশের বাইরে। এরপরও বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক ফখর উদ্দিনের উৎসাহ পেয়েছিলেন। নাইক্ষ্যছড়ি হাজি এম এ কালাম ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অন্য শিক্ষকদের চেয়ে কাজি আয়াছুর রহমান তাকে আলাদা চোঁখে দেখতেন। স্যার বলতেন- ‘তুমি ভাল করে পড়লে অনকে দূর যেতে পারবে।’ রবিউল আলম ভবিষ্যতে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী শিক্ষক হতে ইচ্ছুক। বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ের এফ.রহমান হলে থেকেই সে পড়াশোনা করছে।

সূত্র জানায়, রবিউল আলম ওরফে রবি কৃষক বাবা নুরুল আমিন ও গৃহিনী মা মছুদা খাতুনের চতুর্থ সন্তান। তার বড় দুবোন আনোয়ারা বেগম আর মনোয়ারা বেগম পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই শশুর বাড়ি পাড়ি দেন। বড় ভাই মনিরুল আলম মনির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছোট বোন সেলিনা আক্তার গ্রামের স্থানীয় থিমছড়ি হামিদিয়া দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম এবং ছোট ভাই শফিউল আলম একই মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।