ইমাম খাইর, সিবিএন:
রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রীক বিদেশীদের সন্দেহজনক বিচরণ বেড়ে চলছে। শুধুমাত্র ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে ঢুকে মাসের পর মাস থেকে যাচ্ছে অবৈধভাবে। কোন ধরণের ওয়ার্ক পাসপোর্ট ছাড়াই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকুরী করে যাচ্ছে বিদেশীরা। পদ-পদবী সম্বলিত আইডিকার্ড গলায় ঝুলিয়ে চলছে। ট্যুরিস্ট ভিসায় কর্মস্থলে অফিস করছে প্রকাশ্যে। অনেকে কৌশল হিসেবে ট্যুরিস্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হলে স্বদেশে গিয়ে একই ভিসায় আবার ফিরছে কর্মস্থলে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এনজিওকর্মীর ছদ্মবেশী সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ঘোরাঘুরি করছে বলে অভিযোগ অনেক দিনের। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা জরুরী মনে করছে বিশ্লেষকরা।
এদিকে গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ১৮৭ জন বিদেশী নাগরিক আটক করে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। যাদের অনেকের পাসপোর্ট, ভিসা আপটুডেট ছিলনা। সেখান থেকে ১৭৭ জনকে মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হলেও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ভোগ করতে হয় ১০ জনকে।
সর্বশেষ রবিবার (১১ মার্চ) রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বিদেশি এনজিওতে কাজ করার অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) না থাকায় ৩৯ বিদেশির পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। উখিয়ার মালভিটাপাড়া রাস্তার মাথায় বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করে তাদের আটক করে থানা পুলিশ। ওয়ার্ক পাসপোর্ট বিহীন এসব বিদেশিদের পাসপোর্টগুলো জব্দ করা হয়। আটকরা মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, ইটালিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক।
বিদেশি এনজিও হোপ ফাউন্ডেশন, স্যাভ দ্যা সিলড্রেন, তুর্কি, এমএফএস, নরওয়ে খ্রিষ্টান এইড, রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল, এসিটি ইন্দোনেশিয়া, ডেনিস কাউন্সিল, এফএইচ ইন্টারন্যাশনাল ও মার্কস ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি এনজিওতে বিভিন্ন পদে তারা কর্মরত।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসাইনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিবিএনকে বলেন, ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করার বিধান কোন দেশে নাই। একটি মানবিক ইস্যুতে এনজিওগুলো কাজ করলেও নিয়ম মানা দরকার। তিনি বলেন, সবার সাথে আলোচনা করে করণীয় ঠিক করা হবে। আইনগত বিষয়টি আমলে আনা হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধান করে জানা গেছে, ২০১৭ সালের গত ৩ অক্টোবর কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির সময় ১৫০ জনকে আটক করা হয়। পরে তাদের মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হয়। তখন থেকে নিরাপত্তা রক্ষাসহ বিশৃঙ্খলা এড়াতে রোহিঙ্গা শিবিরে বিনা প্রয়োজনে বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জেলা প্রশাসন।
৬ নভেম্বর:
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার অভিযোগে পাঁচ বিদেশীসহ ২৬ জনকে আটক করে পুলিশ। সেখানে একজন চায়নিজ ও চারজন যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তাদের মধ্য থেকে ১০ জনকে এক মাস থেকে ছয় মাস কারাদ-, বাকীদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয় জেলা প্রশাসন।
২৩ ফেব্রুয়ারি:
যথাযথ অনুমোদন ছাড়া চলাচলের দায়ে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন রোহিঙ্গা ত্রাণ কেন্দ্রের সামনে থেকে ১১ বিদেশিকে আটক করে র‌্যাব। তাদের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও ইতালির দু’জন করে, নেদারল্যান্ড, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, কেনিয়া, ব্রাজিল, বেলজিয়াম ও নরওয়ের একজন করে নাগরিক। তারা ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্সের (এমএসএফ) সঙ্গে জড়িত ছিল।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, এরা ট্যুরিস্ট ভিসায় বা ব্যবসায়িক পারমিটে বাংলাদেশে এসে কাজে যোগ দিয়েছে। এরপরও আমরা এদের আটক করছি না। যেহেতু তাদের এদেশে অবস্থানের মেয়াদ রয়েছে তাই সংশ্লিষ্ট এনজিও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব পাসপোর্টধারীদের ওয়ার্ক পারমিট করে নেয়ার তাগাদা দেয়া হচ্ছে। তাদের করা কাজটি বাংলাদেশি আইন বহির্ভূত এটি জানিয়ে প্রথমবারের মতো সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। ওয়ার্ক পারমিট না করলে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গত বছরের ২৫ আগষ্ট থেকে ১০ লাখের বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাদের ত্রাণ সহায়তা ইস্যুতে বিদেশীদের তৎপরতা আশঙ্কাজনক বেড়েছে। অভিযোগ ওঠে রোহিঙ্গাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রতি উদ্ধুদ্ব করার।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবার নামে প্রায় ১৭৪টি দেশী-বিদেশী এনজিও সংস্থা উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে। ত্রান সামগ্রী বিতরণ থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা, শিশু বিকাশ, নারী বান্ধব কার্যক্রম, ওয়াটার, স্যানিটেশন ও সেড নির্মাণ করে আসছে। তবে, মানবিক কাজে এসে কিছু বিদেশী এনজিও কর্মকর্তাদের অভিজাত হোটেলে থাকা, খাওয়া, অফিস কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লোকবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। অনেক এনজিওর কর্তা ব্যক্তিরা গোপনে স্বজনদের ডেকে এনে চাকুরী দিচ্ছে। যারা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে সেখানেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয়দের চাকুরী দিতে গড়ি মসি করছে এনজিওর হর্তাকর্তারা। বিশেষ করে বিদেশী এনজিওতে স্থানীয়দের পাত্তাই দেয়া হচ্ছেনা।
অভিযোগ উঠেছে, বেশ কয়েকটি এনজিও স্থানীয় আবেদনকারীদের না দিয়ে রোহিঙ্গাদের চাকুরী দিয়েছে। শুধু তাই নয়, উত্তর বঙ্গের ভাই-বোন থেকে শুরু করে শালক শালিকা ও আত্মীয় স্বজন এনে চাকরিতে নিয়োগ দিচ্ছে। কিছু এনজিও কর্মকর্তা লোভের বশিভুত হয়ে চাকুরী দেয়ার নামে আবেদনকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলে উখিয়া-টেকনাফের ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার শিক্ষিত যুবক যুবতিরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, দেশী- বিদেশী এনজিও সংস্থা সরকারের নির্দেশ অমান্য করে রংপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া, নাটোর, খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চল থেকে লোক এনে ক্যাম্পে চাকরি দিচ্ছে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্গন করে ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া শত শত রোহিঙ্গাদেরকে চাকরি দেওয়া হযেছে। এতে করে উখিয়ার শিক্ষিতরা চাকরি থেকে বঞ্চিত।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের সহ সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার সিবিএনকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থানীয়দের বাদ দিয়ে এনজিও কর্তা ব্যক্তিরা তাদের ভাই বোন শ্যালকসহ আত্মীয় স্বজনদেরকে ডেকে এনে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত করা উচিত। জনগণ ফুঁসলে তাদের দমানো দায় পড়বে।