ঘাতকের ভূমিকায় বাস মাইক্রোবাস টমটম, শঙ্কা সবার মাঝে

শাহেদ মিজান, সিবিএন:
মহাসড়ক, অভ্যন্তরীণ সড়ক কিংবা স্থানীয় সড়ক। শহর কিংবা গ্রাম-কোথাও যেন নিস্তার নেই। বাস কিংবা, মাইক্রো, অটোরিক্সা কিংবা টমটম। সবখানে মৃত্যু দূত হয়ে বসে আছে গাড়িগুলো। প্রতিনিয়ত এবং মুহূর্তের মধ্যে মানুষের মূল্যবান জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে এই ‘ঘাতকেরা’। দিন দিন এই করুণ মৃত্যুর মিছিলে সংখ্যা বেড়ে চলছে। এই কারণে মানুষ এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারেন্টি অনেক বেশি শঙ্কিত। অপ্রত্যাশিত মৃত্যুদূত কখন, কোন মুহূর্তে থাবা মেরে নিয়ে প্রাণ-পিঞ্জিরা- এই নিয়ে শঙ্কা। শিশু থেকে যুব, বৃদ্ধ কেউ এই মৃত্যুশঙ্কার বাইরে নেই। সকলে একপ্রকার মৃত্যু তাড়ায় পার করছে দৈনন্দিন জীবন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে সচেতন মানুষের প্রতিক্রিয়াটা এমন।

সাধারণ লোকজনের বক্তব্য, দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়াও মানুষের আরো অনেক অস্বাভাবিক কারণ রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাতেই এখন বেশি অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন মানুষ। দেশজুড়ে একই চিত্র। গণমাধ্যমে চোখ বুলালেই এই দৃশ্য চোখে পড়ে। শহর ও গ্রাম- দেশের জেলা ও উপজেলায় সমান হারে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। এতে অকাতরে মারা পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করছে তার চেয়েও বেশি।
সূত্র মতে, দেশের সব জেলা-উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে থাকলেও কক্সবাজার জেলায় এই চিত্রটা আরো ভয়াবহ। কক্সবাজারে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক, কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক, মেরিনড্রাইভ প্রায়শই ঘটতে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশতেই মারা যাচ্ছে মানুষ। এতে যাত্রী যেমন মরছে তেমনি মরছে পথচারীও। এসব সড়কে দুর্ঘটনার শিকার গাড়ির মধ্যে দূর-পাল্লার বাস, মাইক্রো, সিএনজটি অটোরিক্সা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘাতকের ভূমিকায় থাকে বাসগুলো। অনেক ক্ষেত্রে মাইক্রোও ঘাতকের ভূমিকায় থাকে। বাস ও মাইক্রো’র শিকার হয় ছোট গাড়িগুলো।

অন্যদিকে গ্রামে-গঞ্জে আগে তেমন সড়ক দুর্ঘটনা থাকলে বর্তমানে সেখানেও সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে মানুষ। সেখানে ৯০ শতাংশই প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে টমটমগুলো।

জানা গেছে, গত এক মাসে কক্সবাজার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনা মারা গেছেন ৩০জনের বেশি মানুষ। আহত হয়ে পঙ্গত্ব বরণের সংখ্যা তার দিগুণ থেকে তিনগুণ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে মহেশখালীতে শুধু টমটম দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১০জন।

এই একমাসের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত দুর্ঘটনা এবং বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যায় ৩ মার্চ। ওই দিন শুধুমাত্র চকরিয়াতেই তিনটি পৃথক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ছয়জন। আহত হয়েছেন ১৫ জন। এরমধ্যে হারবাংয়ে সংঘটিত শ্যামলী পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে দুইটি প্রাইভেট নোহা মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংর্ঘষের ঘটনায় মারা যায় চালকসহ চারজন। ছয়জন গুরুতর আহত হয়। অপরদিকে মহাসড়কের মালুমঘাট এলাকায় মোটর সাইকেল ও টমটমের মধ্যে সংর্ঘষে এক মোটর সাইকেল আরোহী যুবক এবং মহাসড়কের খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া ঢালায় মিতালী পরিবহনের বাস চাপায় আরেক মোটর সাইকেল আরোহী অপর যুবক মারা যায়। এই ছয়জনের মৃত্যু মৃত্যু দেশজুড়ে আলোচিত হয়। মহেশখালীতে টমটমের আঘাতে একমাসে শিশু ও বৃদ্ধসহ ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাসড়কে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে চলছে। তার চেয়েও বেশি বেড়ে চলছে চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালনা ও প্রতিযোগিতামূলক ওভারটেকিং। দুর্ঘটনার কারণের মধ্যে এই দু’টি কারণই মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে। সেই সাথে ঝুুঁকিপূর্ণ বাঁক, অদক্ষ, মাদকাসক্ত চালক এবং চালকদের ঘুম চোখে গাড়ি চালানো দায়ী। এছাড়াও বেপরোয়া দূরপাল্লার বাসগুলো ছোট গাড়িগুলোকে পাত্তাই দেয় না। বাসগুলো অনেক সময় পুরো সড়ক দখলে রাখা, ছোট গাড়িগুলোকে ওভারটেকিংয়ে পাশ না দেয়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে।

অন্যদিকে, শহর ছাড়িয়ে গ্রামে-গঞ্জে ব্যাঙের ছাতার মতো বিচরণ করছে টমটম। স্বাভাবিকভাবে টমটমের ব্রেক অনেক হালকা। তার উপর এসব টমটমগুলো চালাচ্ছে কোনো ধরণের প্রশিক্ষণহীন চালকেরা। এই চালকের কাতারে রয়েছে বেকার, অন্য সব কাজে ব্যর্থ, বখে যাওয়া যুবকসহ আনাড়ী লোকজন। একদিকে হালকা ব্রেক অপরদিকে অদক্ষ ও আনাড়ী চালক- সে কারণে প্রতিনিয়ত টমটম দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
গাড়িতে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় লোকজন এখন চরম শঙ্কিত। বিশেষ করে ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষাসহ নানা কারণে যারা নিয়মিত গাড়িতে ভ্রমণ করেন তারা অতিমাত্রায় শঙ্কিত। তারা প্রতিমুহূর্ত দুর্ঘটনা আশঙ্কা নিয়ে ভ্রমণ করছেন দীর্ঘ পথ। তেমনিভাবে গ্রামেও টমটমের ভয়ে আতঙ্কিত লোকজন। সেখানে শিক্ষাঙ্গনগামী শিশু, কিশোর ও যাত্রীরা বেশির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এতে সন্তানদের নিয়ে অভিভাবকেরা বড়বেশি শঙ্কিত হয়ে আছেন।

এ ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কক্সবাজার জেলা সভাপতি জসিম উদ্দীন কিশোর বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। এতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এরমাঝে শঙ্কিত হয়ে জীবন পার করছে মানুষ। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে সেভাবে প্রশাসনের কঠোরতা বাড়েনি। সময় এসেছে লাগাম টানার। প্রশাসন এবং সর্ব স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আন্দোলনে নামতে হবে। না হয় মৃত্যুর মিছিল আরো লম্বা হবে।’

ট্রাফিক ইন্সট্রাক্টর নূরুল আমিন বলেন, ‘সড়কে অদক্ষ ও আনাড়ী চালক অনেক বেড়ে গেছে। সেই সাথে মাদকাসক্ত চালকের সংখ্যাও কম নয়। এর সাথে প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালনা। এসব কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলছে।’

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা রোধে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে। অদক্ষ ও আনাড়ী চালক এবং প্রতিযোগিতামূলকভাবে গাড়ি চালনার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’