হাবিব হাসান , রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে :

আজকে বন্ধু ইব্রাহীম এবং আমার কাজ ছিল বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে। প্রায় ১.৫ কি:মি ক্যাম্পের ভেতর যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের একটি দোকানে আমরা বসলাম। হঠাৎ একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী আমাদের পাশে এসে আমাদের কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। ওনাকে আমার পাশে বসালাম। ইব্রাহীম লোকটিকে বলল চাচা কেমন আছেন? লোকটির ভাল আছি বলার ধরনটিও ছিল অন্য রকম।
বৃদ্ধ লোকটির নাম ছৈয়দুল আলম (৭৩)। পূর্বে বাড়ি ছিল মায়ানমার (বার্মা) মন্ডুতে। চৌদ্দ বিগা জমির মালিক ছিলেন তিনি। এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট একটি বাড়িতে তার বাস। অামাদের ভাব জমে ওঠায়  ছৈয়দুল আলম  মনের সব কথা  বলতে লাগলেন। যেন এক বিশাল পাথর খন্ড শরীর থেকে নামানোর চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশে আসার সময় তার সাথে ছিল স্ত্রী, দুই মেয়ে, বড় মেয়ের জামাই এবং দুই নাতি। নয় দিন হাঁটার পর বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছায় ছৈয়দুল আলমের পরিবার। নাফনদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হবে তার পরিবারকে। পবিত্র ঈদুল আযহার দিন ভোর ছয়টায় তাঁর পরিবার নাফনদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসবে। ছৈয়দুলের আশা ছিল যদি তাঁর পরিবার তাড়াতাড়ি নাফনদী পার করতে পারলে ঈদের নামাজটা  বাংলাদেশে পরবে। সেটা ছিল শুধু স্বপ্ন। নৌকায় তার পরিবারের সাত জন সদস্য সহ প্রায় চল্লিশ জন লোক ছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নৌকাটি দশ-পনেরো মিনিট চলার পর নাফনদীর ঢেউয়ের কাছে হেরে যায়। ছৈয়দুল আলমের পরিবারের সব সদস্যসহ ঐ নৌকা ডুবে যায়। ঐ সময় ছৈয়দুল আলম এর কোলে ছিল তার ছোট নাতনী। মূহর্তের মধ্যে কে কোথায় চলে গেল বুঝতে পারেনি ছৈয়দুল। সে কথা বলতে না বলতেই চোখের জলে টলমল করছিল বৃদ্ধ ছৈয়দুলের চেহারা। জিজ্ঞাসা করলাম – তারপর কি হল ?
ডুবে যাওয়ার পর নাকি তার কোলে বসে থাকা নাতনীকে এক হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটেন তিনি। কিন্তু শক্তির কারণে নাতনীকে বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারেননি। একসময় নাতিকে হাত থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।এর পর আর কিছু মনে নাই তার। পরে তিনি জানতে পারেন তাকে অন্য আরেকটি নৌকা মৃত মনে করে তুলে নেয়।  রাখে আল্লাহ মারে কে, ছৈয়দুল এখনো বেঁচে আছে কিন্তু পরিবারের কোন জীবিত সদস্যের সাথে তার আর দেখা হয়নি। ঐ ঘটনার তিনদিন পর তার বড় মেয়ের মরদেহ পাওয়া যায়। এর পর নাকি ছৈয়দুল একমাস নাফনদীর পাড়ে ছিল, যদি কারও লাশ পাওয়া যায় সে আশা নিয়ে। পরে দোকানদারের কাছে জানতে পারলাম কোন নতুন চেহারার মানুষ দেখলেই ছৈয়দুল তার মনের কষ্টের কথা বলে।
সৈয়দুল এখন শুধু একটা কথায় বলে যে, কখন তার মৃত্যু হবে । কখন এই কষ্টেভরা শূন্য জীবন থেকে মুক্তি পাবে।
এই বৃদ্ধ ছৈয়দুলের চোখের পানি দেখে তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলি আমরা।
এই রকম আরও অনেক ছৈয়দুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে, যারা তাদের সব সম্পত্তি টাকা পয়সা আত্মীয় স্বজন হারিয়ে নি:স্ব হয়ে  হাহাকার করছে।

হাবিব হাসান

কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর হচ্ছে,, টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত একবার হারালে আবার পাওয়া যায়। কিন্তু জীবন চলে গেলে আর পাওয়া যায় না। সবকিছু হারানোর বেদনা নিয়ে ছৈয়দুলরা অপেক্ষায় আছে জীবনের অন্তিম মুহূর্তের , যেপারে গেলে নাফনদীর ঢেউয়ে হারিয়ে যাওয়াদের পাওয়া যাবে!

– ডিসেম্বর ০৬, ২০১৭