আজিম নিহাদ :
বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে শহরের সমিতিপাড়ার কুতুবদিয়া পাড়া এলাকার ১৩ বছরের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নিহতের পরিবারকে হুমকির মুখে রেখে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ট্রলার মালিক ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর ২৩ অক্টোবর থেকে সাগরে মাছ ধরা শুরু হয়। সেই হিসাবে ২৩ অক্টোবর সাগরে মাছ ধরতে যায় শহরের সমিতিপাড়ার কুতুবদিয়াপাড়া এলাকার জাফর মাঝির মালিকাধীন একটি ফিশিং ট্রলার। ওই ট্রলারে অন্যান্য জেলেদের সাথে মাছ ধরতে যায় ১৩ বছরের এক শিশু। তার নাম সোলাইমান। সে পশ্চিম কুতুবদিয়া পাড়ার বেদার উদ্দিনের ছেলে। গত ২৭ অক্টোবর বিকালে সোলাইমান নামে ওই শিশুর লাশ নিয়ে ফিরে ট্রলারটি। পরে ওইদিনই সোলাইমানের লাশ তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়। পরে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এমনকি ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে কোথাও অভিযোগ না করতে নিহতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
কূলে ফিরে ওই ট্রলারের জেলেরা ট্রলার মালিক জাফর মাঝি ও সোলাইমানের পরিবারের কাছে জানান, গত ২৭ অক্টোবর সকালে ট্রলারে মেশিন পারাপারের সময় ইঞ্জিনের সাথে ধাক্কা লেগে আঘাতপ্রাপ্ত হয় সোলাইমান। পরে আহত সোলাইমানকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কূলে ফেরার পথে তার মৃত্যু হয়।
সোলাইমানের লাশ নিয়ে যখন জেলেরা কূলে ফিরেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন দু’জন ব্যক্তির সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারাও পেশায় জেলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই দুই ব্যক্তি জানান, সোলাইমানের শরীরের ওপরের অংশে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন ছিল। তার বাম হাতের ওপরে ও গলা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তার হাতের তিনটি আঙ্গুলও সম্পূর্ণ কাটা ছিল।
তারা আরো জানান, সোলাইমানের শরীরে যেভাবে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, তাতে পারাপারের সময় মেশিনে লেগে পাওয়া আঘাত বলে মনে হয় না। তারা ধারণা করছেন, শিশু সোলাইমানকে জোর করে মেশিন চালানোর কাজে লাগানো হয়েছিল। সেখানে অন্যান্য জেলেদের অগোচরে মেশিনে আঘাত পেয়ে মারা যায় সে। তাছাড়া মাছ ধরার ট্রলারের মেশিনের ওপর একটি বাক্স স্থাপন করতে হয়। নিরাপত্তার জন্য ট্রলারের নিবন্ধনে এটি বাধ্যতামূলক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু জাফর মাঝির ট্রলারে কাঠের এই বাক্সটি ছিল না।
আবার অনেকে ধারণা করছেন, সোলাইমান বয়সে ছোট ছিল। এই বয়সে তার মাছ ধরতে যাওয়ার কথা নয়। এবং শিশুদের এই কাজে নিয়োজিত করাও সম্পূর্ণ অন্যায়। এছাড়া সোলাইমানকে সাগরে মাছ ধরতে নিয়ে যাওয়া হয় জোর করে। এখানে অন্যকোন বিষয় থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় অনেকে।
নিহতের পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ অক্টোবর রাতে শিশু সোলাইমানকে (১৩) জোর করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান জাফর মাঝি। পরে খবর পেয়ে রাতে ছেলের খোঁজে জাফর মাঝির বাড়িতে যান সোলাইমানের বাবা বেদার উদ্দিন। ওই সময় তাঁর ছেলে নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন বলে জানানো হয় তাকে। কিন্তু তৎসময়ে সোলাইমানকে জিম্মি করে রাখা হয় জাফর মাঝির বাড়িতে। পর দিন ২৩ অক্টোবর সকালে ট্রলারে তুলে সোলাইমানকে মাছ ধরতে সাগরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সোলাইমানের বাবার কাছে তাকে সাগরে পাঠানোর কথা স্বীকার করেন জাফর মাঝি। কিন্তু মাছ ধরা শেষ হওয়ার আগেই ২৭ অক্টোবর লাশ হয়ে ফিরে বেদার উদ্দিনের শিশুপুত্র সোলাইমান।
ছেলের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন বেদার উদ্দিন। ওই সময় তিনি বলেন, তার অজান্তে ছেলেকে জিম্মি করে সাগরে মাছ ধরতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবী করছেন তিনি।
কিন্তু বেদার উদ্দিনকে ঘটনাটি সম্পর্কে পুলিশ বা অন্য কোথাও জানাতে দেননি জাফর মাঝি ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। এক পর্যায়ে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে তাকে ক্ষতিপূরণের নামে আর্থিক প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে শুরু থেকে তৎপর হয়ে উঠেন জাফর মাঝি। এজন্য তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আক্তার কামাল ও কয়েকজন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে সবাইকে ম্যানেজ করেন।
সূত্র জানায়, ঘটনার পর কুতুবদিয়া পাড়ায় স্থানীয়ভাবে বৈঠক বসে। সেখানে আক্তার কামাল নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে এক লক্ষ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এবং তিনি বিষয়টি মিমাংসা করে দেন। আর এই বিষয় সম্পর্কে পুলিশ বা অন্য কোন জায়গা না জানানোর জন্য নিহতের পরিবারকে কড়া হুশিয়ারি দেন। ওই সময় জোর করে পরিবারের কাছ থেকে আপষের স্ট্যাম্প নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে ট্রলারের মালিক জাফর মাঝি বলেন, ‘এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র। আর কমিশনার আক্তার কামালের মাধ্যমে নিহতের পরিবারের সাথে বিষয়টি আপোষ করা হয়েছে। তার পরিবারকে বেশকিছু টাকাও দেওয়া হয়েছে। এখন আবার এই বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন?’
১৩ বছরের শিশুকে কেন মাছ ধরতে নিয়ে যাওয়া হয় এমন প্রশ্নে জাফর মাঝি বলেন, ‘ঘটনা যখন হয়ে গেছে, এটি নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কিছু নেই। অন্যায় হলেও এখন আর তার বিরুদ্ধে কিছু করার নেই। কারণ তাকে নিহতের পরিবার টাকা নিয়ে আপষের স্ট্যাম্প দিয়েছে’।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার আক্তার কামাল বলেন, ‘ট্রলারে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শিশুটি মারা গেছে বলে তিনি শোনেছেন। এরপর স্থানীয়ভাবে বৈঠক করে মিমাংসা হওয়ার কথাও স্বীকার করেন তিনি। তবে ১৩ বছরের একটি শিশুকে কেন সাগরে মাছ ধরতে নিয়ে যাওয়া ও তিনি জ্ঞাত হয়েও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি কমিশনার। তবে তিনি কৌশলে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘নিহতের পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে। তাই তিনি ঘটনাটি পুলিশ বা অন্যকোন আইন প্রয়োগকারি সংস্থাকে জানানো প্রয়োজন মনে করেননি’।
এবিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি রনজিত কুমার বড়–য়া বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।