*কোনো বিদেশিকে নিয়োগ দেয়া যাবে না

* বেতন কাঠামো ও প্রবিধানমালার আলোকে জনবল নিয়োগ

* বিধান অনুযায়ী চাকরিচ্যুতি

* কোনো বিভাগ পরিচালনায় নির্দিষ্টসংখ্যক পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক

যুগান্তর :

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা রাজনীতি করতে পারবেন না। পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিক ছাড়া অন্য কাউকে কোনো পদে নিয়োগ দেয়া যাবে না। আর বেতন কাঠামো ও প্রবিধানমালার আলোকে নিশ্চিত করতে হবে সব স্তরের চাকরি। এ ক্ষেত্রে যখন-তখন কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। শুধু তাই নয়, একটি বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্টসংখ্যক পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
এসব বিধান অন্তর্ভুক্ত করে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসনিক, আর্থিক ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পাদন সম্পর্কিত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে-সংবিধির গাইডলাই’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইউজিসি (ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ড কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন)। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গাইডলাইনটি চূড়ান্ত করে আগামী এক মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উচ্চশিক্ষার আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতেই আমরা এ গাইডলাইন তৈরি করছি। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৭ ধারায় প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলকভাবে সংবিধি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু দু-একটি বাদে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তা তৈরি করেনি। আবার সংবিধি যা হয়েছে তা নিজেদের স্বার্থে করেছে। তাছাড়া সংবিধিগুলো একেকটি একেক রকম। এ কারণে আমরা একটি আদর্শ সংবিধির গাইডলাইন তৈরি করছি।’
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসনিক, আর্থিক ও অন্যান্য কার্যাবলি পরিচালনার বিষয়ে ৩৭টি দিকনির্দেশনা আছে গাইডলাইনের খসড়ায়। এর আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব সংবিধি তৈরি করে তা চ্যান্সেলর বা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নেয়ার ব্যাপারেও ইউজিসি নির্দেশনা দেবে।
এ ব্যাপারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেট এই আইন, বিধি এবং সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক প্রণীত আদেশ ও নীতিমালার আলোকে, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসনিক, আর্থিক ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পাদন সম্পর্কিত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়-সংবিধি প্রণয়নপূর্বক বোর্ড ট্রাস্টিজ (বিওটি) ও সরকারের মাধ্যমে চ্যান্সেলরের অনুমোদন গ্রহণ করিবে।’
ইউজিসি চেয়ারম্যান যুগান্তরকে বলেন, ‘সংবিধির মেয়াদ সাধারণত দু’বছর। বর্তমানে যে ক’টির সংবিধি আছে, সেগুলোর মেয়াদও পেরিয়ে গেছে। আসলে সংবিধি ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। এ কারণে আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি। ওই কমিটি সংবিধির মডেল তৈরি করবে। সেটি মাস খানেকের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠিয়ে দেব। সেটার আলোকে সংশ্লিষ্টদের একটি সংবিধি করার অনুরোধ করা হবে। এরপর তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চ্যান্সেলরের অনুমোদন নিতে হবে।’
সংবিধির প্রস্তাবিত গাইডলাইনে ৩৭টি দিক উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার ও ইউজিসির ভর্তির যোগ্যতা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আইন অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩ ভাগ এবং দরিদ্র মেধাবীদের বিনা মূল্যে পড়াতে হবে। টিউশনসহ অন্য ফি নেয়া যাবে না। এ ধরনের শিক্ষার্থীর তালিকা ইউজিসিকে দিতে হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির অনুমোদন ছাড়া ইচ্ছামতো আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করে। কোটা শিক্ষার্থী ভর্তির তথ্য গোপন রাখে। আবার যে ক’জন ভর্তি করে, তাদের পরীক্ষা, সেশনসহ নানা ফি’র নামে অর্থ আদায় করে থাকে।
গাইডলাইনের খসড়ায় বলা হয়, প্রত্যেক বিভাগে নির্ধারিতসংখ্যক পূর্ণকালীন শিক্ষক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইউজিসির নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। শিক্ষার্থী মূল্যায়নে ইউজিসির অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তবে একজন শিক্ষক একসঙ্গে কতটি পূর্ণকালীন চাকরি করতে পারবেন, সেটি উল্লেখ নেই প্রণীত খসড়ায়। বর্তমানে অনেক শিক্ষক একই সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন চাকরি করেন।
প্রস্তাবিত গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত কোনো শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী রাজনৈতিক কোনো দলের সঙ্গে জড়িত হতে পারবেন না। রাজনৈতিক মতামত প্রচার করতে পারবেন না। তবে রাজনৈতিক মতামত পোষণের স্বাধীনতা ভোগ করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে কোনো বিদেশিকে নিয়োগ দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ছাড়পত্র লাগবে। নিয়োগে শিক্ষানবিশ কাল হবে ২ বছর। প্রয়োজনে এক বছর বাড়ানো যাবে। এর বেশি নয়। পুলিশের প্রতিবেদন এবং শিক্ষানবিশকাল সন্তোষজনক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী নিয়োগ করা যাবে। পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদনে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কোনো কার্যে লিপ্ত থাকার বিষয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য থাকলে স্থায়ী নিয়োগ করা হবে না। এ ক্ষেত্রে এক মাসের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে। খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য অবশ্যই উপযুক্ত বেতন কাঠামো ও চাকরি প্রবিধানমালা তৈরি করে ইউজিসিকে অবহিত করবে। এ ক্ষেত্রে ইউজিসি মতামত দিতে পারবে। নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ অন্তত ৫ বছর চাকরি করলে আনুতোষিক এবং কমপক্ষে ১০ বছর চাকরি করলে অবসর ভাতা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই সরকারের নির্ধারিত হারে ভাতা দিতে হবে।
এ ছাড়া তিন মাসের নোটিশ বা তিন মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে চাকরির অবসান করানো যাবে। আর এক মাসের নোটিশ বা এক মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে শিক্ষানবিশের চাকরি থেকে অবসান দেয়া যাবে। নিয়োগপ্রাপ্তদের সার্ভিস বুক থাকবে। তাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ১৬টি বিষয় উল্লেখ থাকবে। এমএলএসএস ছাড়া বাকিদের এসিআর নির্দিষ্ট ফরমে সংরক্ষণ করতে হবে। স্থায়ী নিয়োগের তারিখ থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে। নিয়োগপ্রাপ্তরা সাত ধরনের ছুটি ভোগ করতে পারবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে উল্লিখিত কোনো বিধানই কার্যকর নেই। বিশেষ করে, যখন যাকে ইচ্ছা নিয়োগ বা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটছে। এ ব্যাপারে ইউজিসিতে প্রায় প্রতিদিনই ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পড়ছে।
বিওটি আইনের ১৬ ধারায় বর্ণিত ১০টি কাজের বাইরে অন্য কিছু করতে পারবে না। বিওটির ন্যূনতম কতজন সদস্য নিয়ে সভার কোরাম হবে, সেটা সংবিধিতে উল্লেখ থাকতে হবে। প্রতি ৬ মাসে অন্তত একটি বৈঠক করতে হবে বিওটির। সিন্ডিকেটের সভাপতি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। প্রতি ৩ মাসে সিন্ডিকেটের একটি করে সভা করতে হবে। তবে এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের স্বাক্ষরে ভিসি বিশেষ সিন্ডিকেট সভা ডাকতে পারবেন।
সংবিধিতে ভিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী ও একাডেমিক কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করতে হবে। তবে তিনি তার কার্যক্রমের জন্য বিওটির কাছে দায়ী থাকবেন। ভিসির নির্দেশে ট্রাস্টি বোর্ড, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভা রেজিস্ট্রার আহ্বান করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ভিসি দায়ী থাকবেন। তিনি শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ ও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
ভিসির দেয়া ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন প্রোভিসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আর্থিক কর্মকাণ্ডের জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন কোষাধ্যক্ষ। তিনি তহবিলের সার্বিক তত্ত্বাবধান করবেন। বার্ষিক বাজেট ও হিসাব বিবরণী পেশ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দায়ী থাকবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তির হেফাজত ও তত্ত্বাবধান করবেন রেজিস্ট্রার। বিওটি, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সচিব হবেন তিনি। পাশাপাশি তিনি শিক্ষা প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠু বাস্তবায়নের বিষয়ে ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে কার্যকর ও ফলপ্রসূ যোগাযোগ রক্ষা করবেন।
গাইডলাইনে পাঠক্রম কমিটি, অর্থ কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ কমিটি, শৃঙ্খলা কমিটির কথা উল্লেখ আছে। তবে এতে সরকারি প্রতিনিধি রাখার কথা উল্লেখ নেই। এ ছাড়া ডিনের ১৬টি, বিভাগীয় প্রধানের ১৩টি এবং একাডেমিক কাউন্সিলের ৮টি কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।