আমান উল্লাহ আমান, টেকনাফ: 

উখিয়া ও টেকনাফে লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের তীব্র জ্বালানী সংকট দেখা দিয়েছে। আর তাদের কারণে দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে সবুজ বনায়ন। প্রায় বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী। টেকনাফ’র নয়াপাড়া ও হোয়াইক্যংয়ের রইক্ষ্যং রোহিঙ্গা শিবির সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এসব চিত্র।

সুত্রে জানা যায়, টেকনাফ-উখিয়ার পাহাড়গুলো একসময়ে বড় বড় গাছে ভরপুর ছিল। এর মধ্যে গর্জন (মাদার ট্রি), সেগুন ও জাম গাছ উল্লেখ্যযোগ্য হারে বেশী। এছাড়া হাতি, বানর, হরিণ, বন মোরগসহ নানা প্রজাতির পশুপাখির কলকাকলীতে মুখরিত থাকতো পাহাড়গুলো। ১৯৯১-৯২ সনে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা এসে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানের কারনে বনজ সম্পদ উজাড় হয়।

গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হলে পুনরায় দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে আবারো বিভিন্ন পাহাড়ের পাদ দেশে আশ্রয় নেয়। ফের ধ্বংসের কবলে পড়ে বনভুমি।

নয়াপাড়া, রইক্ষ্যং রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা নারী পুরুষরা পাহাড় থেকে লাকড়ী এনে তাদের জ্বালানী চাহিদা মেটাচ্ছে। এতে স্থানীয়রাও পিছিয়ে নেই বন উজাড় থেকে। তারাও রোহিঙ্গাদের নিয়ে শুরু করেছে লাকড়ীর ব্যবসা। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেক পরিবার টাকার অভাবে লাকড়ী কিনতে পারছেনা। আবার পাহাড়েও যেতে পারছেনা। বিশেষ করে পুরুষবিহীন পরিবারগুলোতে মারাত্মক জ্বালানী সংকট দেখা দিয়েছে। তারা জ্বালানীর অভাবে চুলোয় আগুন পর্যন্ত দিতে পারছেনা। ফলে ঠিক মতো রান্না করতেও কষ্ট হচ্ছে তাদের।

তাছাড়া রোহিঙ্গারা পাহাড়ের গাছ কেটে সাবাড় করার ফলে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে বনজ সম্পদ।

বুছিডং’র মিস্যজং গ্রামের বাসিন্দা মৃত মোঃ কাছিমের পুত্র মোঃ আলম (৩০) গত ২৩ দিন আগে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে রইক্ষ্যং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।

তিনি জানান, জ্বালানীর সংকটে রান্না করতে খুবই কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। ঠিক মতো দু’বেলা খেতে মুশকিল। পাহাড়ে গিয়ে লাকড়ী কুড়িয়ে এনে রান্না করতে হচ্ছে। সেখানেও স্থানীয়রা বাধা দিচ্ছে।

একই এলাকার ছৈয়দ আকবরের স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৩৫) চুলোয় ভাতের পাত্র দিয়ে ফুঁক দিচ্ছে। ধোঁয়াই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে গোটা বাসাটি ও গরমে হাঁপিয়ে উঠতে দেখা গেছে। ১’শ টাকায় ৫ পিস লাকড়ীর আঁটি ক্রয় করেছে। তা দিয়েই চুলোয় আগুন জ্বালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ফলে ধোঁয়াতে পুরো বাসাটি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এক প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম বেগম বলেন, ‘নিজের দেশ ছেড়ে এদেশে আসতে হবে কখনো ভাবিনি। নিজ দেশের সেনাদের কবল থেকে প্রাণ বাঁচতে এদেশে এসেছি। নিজের দেশে শান্তি ফিরলে অবশ্যই চলে যাবো। কিন্তু শান্তি না হলে কখনো যাবো না। দরকার হলে এদেশে মরে যাবো তবু ফিরবোনা মিয়ানমারে’।

সিরাজুল্লাহর স্ত্রী মিনারা বেগম (৩২) জানান, ৯ জন ছেলে-মেয়ে ও স্বামী নিয়ে তিনি গত ৩ সেপ্টেম্বর এদেশে এসে রইক্ষ্যং ক্যাম্পে অবস্থান করেছে। ইতিমধ্যে চাল, মরিচ, হলুদ, তৈল, ডাল, লবন, আদা, চিনি, সুজি, দুধ, পিয়াঁজ, রসুন, বালতি, গামলা, মাদুর, ত্রিপল, মশারী, শুকনো মাছ, ময়দা আলু ও কাপড় পেয়েছে। শুধু মাত্র জ্বালানীর অভাবে রান্না করা দুরহ হয়ে পড়েছে। তিনি আরো জানান, তার ৮ ও ১০ বছরের দুই ছেলে পাহাড়ে লাকড়ী সংগ্রহ করতে গেছে। সেখান থেকে ফিরলে চুলোয় আগুন দিয়ে ভাত রান্না করবে। এছাড়া আর কোন উপায় তার নেই। ইতিমধ্যে পুরাতন কাপড় দিয়ে রান্না করেছে কয়েকবার, তাও শেষ হয়ে গেছে। এই পরিবারগুলোর মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবার জ্বালানী সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে পড়েছে বিপাকে পরিবারগুলো। ক্ষুধার অভাবে তাদের কান্নার রোল ছড়িয়ে পড়ে অনেক সময়। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জ্বালানীর বিকল্প চিন্তা না করলে বনজ সম্পদ ধ্বংসসহ পরিবেশের উপর মারাত্মক বিরুপ প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে বলে মত দিয়েছে সচেতনমহল।