আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও আশাবাদী হয়ে উঠেছে বিএনপি-জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী। হাইকোর্টের রায়ে স্থগিত থাকা দলীয় নিবন্ধন, প্রতীক তালিকা থেকে বাদপড়া দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ফেরত এবং অন্তত ৫০ আসনে বিএনপি-জোটের মনোনয়ন চায় দলটি। দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জামায়াতের এই মনোভাব জানা গেছে।

দলটির নেতারা জানান, নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পেতে আইনি লড়াই শুরু করার কথা ভাবছে জামায়াত। এক্ষেত্রে কোনও সুযোগ তৈরি না হলে স্বতন্ত্র পরিচয়েই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে দলটি। তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম জানান, ‘ফুলকোর্ট সভায় দাঁড়িপাল্লাকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত হওয়ায় আইনি লড়াইয়ের কোনও সুযোগ নেই জামায়াতের।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যাশার বিষয়গুলো মাথায় রেখেই নির্বাচনের পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু করেছে জামায়াত। দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা প্রণয়নের কাজ করছেন। ২০ দলীয় জোট থেকেই নির্বাচনের বিষয়টি চূড়ান্ত রেখে প্রার্থীদের অবস্থান যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে জামায়াত। এক্ষেত্রে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৯টি আসনে নির্বাচন করলেও এবার এই সংখ্যাটি বাড়িয়ে নিতে চাইছে দলটির নীতিনির্ধারকরা।

জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার সোমবার বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে দলে। কতগুলো আসনে প্রার্থিতা করা যাবে, সেটি জোটগত সিদ্ধান্ত না হওয়ার আগে বলা যাবে না।’

নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি গণতান্ত্রিক ইসলামী দল। আমরা নির্বাচনে বিশ্বাস করি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য বরাবরই আমাদের ভূমিকা আছে। এখন আছে, আগামী দিনেও থাকবে।’

‘নির্বাচনের প্রস্তুতি সব সময়ই আছে’—বলে মন্তব্য করেন শামসুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা এক সময় ৩০০ আসনে নির্বাচন করেছি। ১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ছাড়া সব সংসদেই আমাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল।’

দাঁড়িপাল্লা প্রতীক পাচ্ছে না জামায়াত

তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্টের একটি রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হয়। এরপর নির্বাচন কমিশন দলটির দলীয় নিবন্ধন স্থগিত করে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী আপিল করেছে, যা এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন সদস্য জানান, ‘নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে, আমরা আইনি লড়াই করবো। আইনি লড়াইয়ের সুযোগ যেহেতু এখনও আছে, সেহেতু দলের নিবন্ধন নিয়েই নির্বাচনের পরিকল্পনা আছে আমাদের। এ বিষয়ে দলের আইনি বিভাগের প্রস্তুতি চলছে।’

গত বছরের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে এবং কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠানোর পর নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি ৯ এর উপবিধি (১) এর ৩২ নম্বর ক্রমিক থেকে ‘দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাতিল করার প্রস্তাব কমিশন সভায় অনুমোদিত হয়। এরপর প্রতীকটি বাদ দিয়ে বিধিমালায় সংশোধন প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর গেজেট প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর ‘দাঁড়িপাল্লা ’প্রতীক নিয়ে ১৪ নম্বর ক্রমিক হিসেবে নিবন্ধন পায় জামায়াত।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একাধিক সূত্র জানায়, ‘দলটির স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচন করার সম্ভাবনাই বেশি, যদি প্রতীক ও নিবন্ধন না আসে। আর নির্বাচনের আগে প্রতীক ও নিবন্ধন ফিরে পেলে দলীয় প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবে তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘তারা কোথায় যাবে?’ বলে পাল্টা প্রশ্ন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ফুলকোর্ট সভায় দাঁড়িপাল্লাকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত হওয়ায় আইনি লড়াইয়ের কোনও সুযোগ নেই জামায়াতের। কোর্টই তো সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।’

তবে জামায়াতে ইসলাম নতুন কোনও প্রতীকের জন্য আবেদন করবে কি না—এ নিয়ে কোনও তথ্য কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সূত্র জানাতে পারেনি। সোমবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ইফতারে এ বিষয়ে জামায়াতের অন্তত ৬জন নেতার সঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের আলাপ হয়।

আসনে আশাবাদী জামায়াত

বিএনপির তরফে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা কী হবে, এ নিয়ে সরকারের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখলেও ভেতরে-ভেতরে দলীয় প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে জামায়াত। দৃশ্যত বিএনপি জোটে অংশগ্রহণমূলক কাজে দলটিকে দেখা না গেলেও জোটের সমর্থনে নির্বাচনকে সামনে রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলটি। তাদের প্রস্তুতি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন গত মাসেই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও অন্তত ৬০টিতে জোটের সমর্থন নেওয়ার চিন্তা ছিল দলটির। ওই সময় ৪৩ টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছিল জামায়াত। আগামী নির্বাচনে এই সংখ্যাটি আরও বাড়বে বলেই জানান ঢাকা মহানগর জামায়াতের শীর্ষ এক নেতা। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সময় তো অনেক গেছে, আগের চেয়ে নিশ্চয় বেশি চাওয়ার চিন্তা আছে আমাদের।’

২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৯টি আসনে জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচন করলেও তৎকালীন বিএনপি-জোট তাদের সমর্থন দেয় ৩৪ টিতে। তবে আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জোটের পরিধি বড় হওয়ায় ও নির্বাচনকালীন সরকার মাথায় রেখে সমর্থিত আসনসংখ্যা কমতে পারে বলে মনে করছেন জোটের অনেকে। তবে আসন বণ্টনভিত্তিক বৈঠকের আগে কেউই এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ।

এ ব্যাপারে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা শামসুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা জোটে আছি, জোটের মধ্যেই থাকব এবং জোটের আলোচনার প্রেক্ষিতেই আসনবণ্টন হবে। আমাদের বাদ দিয়ে তো আলোচনা হবে না।’

তবে ঠিক কত আসনে জোটের সমর্থন চাইবে জামায়াত—এমন প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রামের এই নেতা বলেন, ‘এসব ব্যাপারে না বলি, থাক।’

 

বাংলা ট্রিবিউন