মানবজমিন:

বছরব্যাপী সংঘটিত গুম-খুন তথা স্পর্শকাতর ঘটনাগুলো এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে তথ্য দিয়ে সহায়তাকারী ব্যক্তি এবং মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য বা অবস্থান জানতে চেয়েছে জাতিসংঘ। এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে বলা হয়, সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা ওই সব কেসের বিষয়ে আগামী ১৫ই জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের বক্তব্য পাওয়া জরুরি। অন্যথায় হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিব যে বাৎসরিক রিপোর্ট পেশ করতে যাচ্ছেন তাতে বাংলাদেশের ভাষ্য অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে না। চিঠিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়, মহাসচিবের রিপোর্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত তারিখের পর কারও কোনো বক্তব্য দেয়ার অবকাশ নেই বরং তা দিলেও গৃহীত হবে না। ২৭শে জুন নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনকে লেখা অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর ওই চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিবের রিপোর্টে ১লা মে ২০২১ থেকে ৩০শে এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত সময়কালে বিভিন্ন দেশে সংঘটিত মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর ঘটনাগুলো স্থান পাবে। ওই সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার সংবেদনশীল কিছু ঘটনা রয়েছে, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য দেয়ার সুযোগ রয়েছে। ওএইচসিএইচআর আশা করে ঢাকা সেই সুযোগ গ্রহণ করবে।

‘জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তার প্রতিনিধি এবং প্রক্রিয়া’ শীর্ষক জাতিসংঘ মহাসচিবের ওই বার্ষিক রিপোর্ট সমন্বয় করার দায়িত্ব ওএইচসিএইচআর পেয়েছে জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ১২/২ রেজ্যুলেশন অনুযায়ী মহাসচিব হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে ওই রিপোর্ট প্রদান করে থাকেন। ভীতি প্রদর্শন এবং প্রতিশোধের অভিযোগ নিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ এবং সম্পৃক্ততার ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের সঙ্গে ওএইচসিএইচআর যোগাযোগ রাখে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, এ জন্যই বাংলাদেশ মিশনকে সংযোজিত তথ্যগুলোর পর্যালোচনা করতে জাতিসংঘ আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ও রিপোর্টিং সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন যেকোনো কেসের বিষয়ে নতুন তথ্য বা আপডেট জানাতে পারবে। অর্থাৎ যেকোনো মামলার ডেভেলপমেন্ট শেয়ার করতে পারবে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ যে বক্তব্যই দিক না কেন তা মহাসচিবের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এতে অতীত বা চলমান মামলার আপডেট সংক্রান্ত বাংলাদেশ সরকারের যে প্রতিক্রিয়া দেয়া হোক না কেন মহাসচিবের রিপোর্টের অ্যানেক্সে যথাযথভাবে স্থান পাবে। প্রচারিত সংক্ষিপ্ত সংস্করণের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ব্যবহার করে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন কেসগুলোর বিষয়ে তাদের রিভিউ পর্যালোচনা তুলে ধরার সুযোগের বিষয়টি সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখবে বলে চিঠিতে আশা করে জাতিসংঘ। চিঠিতে যে সব কেসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে- অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর ওই চিঠির সংযোজনীতে দু’টি পরিশিষ্টে বাংলাদেশ সংঘটিত মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো কেসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
চিঠির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পরিশিষ্ট-১ এ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডে জাতিসংঘের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এ কেসের বিস্তারিত তুলে ধরে এর আপডেট জানতে চেয়েছে তারা। এতে ৭৬টি গুমের ঘটনার আপডেট চেয়ে বলা হয়, ২০২১ সালের ৩০শে ডিসেম্বর সরকার ঘোষণা দেয় যে, মুলতবি থাকা ৭৬টি ঘটনা তারা জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেসের (ডব্লিউজিইআইডি) সঙ্গে তদন্ত করছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কর্তৃপক্ষ কিছু ভিকটিমের আত্মীয়দের বাড়িতে উপস্থিত হয় এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। অভিযোগ রয়েছে যে, তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ভিকটিম, বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে কাজ করা এবং জবাবদিহিতায় পরামর্শ দেয় এমন কিছু এনজিও প্রতিনিধিরা এতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অধিকার। ম্যান্ডেট হোল্ডাররা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, ডব্লিউজিইআইডিসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন এনটিটিকে সহযোগিতা করেন মানবাধিকারের পক্ষে থাকা এমন কর্মী এবং ভিকটিমের আত্মীয়দেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়ে থাকতে পারে।

২০২২ সালের ১৪ই মার্চ মানবাধিকারকর্মী এবং জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাদের কর্মকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা এবং জাতিসংঘের মেকানিজমকে সহযোগিতার জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়া বন্ধ করতে প্রকাশ্যে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায় স্পেশাল প্রসিডিউরস ম্যান্ডেট হোল্ডাররা। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এসব প্রতিশোধ নেয়ার ফলে এক হিমশীতল প্রভাব সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। এতে অন্যরা মানবাধিকারসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রিপোর্ট করতে বিরত থাকবেন। জাতিসংঘ, এর প্রতিনিধি এবং মেকানিজমকে সহযোগিতা থেকে বিরত থাকবেন। ২০২২ সালের ১২ই মে সরকার জবাবে বলে যে, নিখোঁজ অথবা অজ্ঞাত রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের উদ্ধারে বা শনাক্ত করতে তাদের পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার। এতে বলা হয়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য তাদের বিষয়ে আরও তথ্য প্রয়োজন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ওই ৭৬টি ঘটনার অনেকেরই রেকর্ড নেই। সরকার জানিয়েছে, তারা তথ্য চেয়ে তাদের আত্মীয়দের কাছে চিঠি ইস্যু করেছে। ভিকটিমদের পরিবারের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদেরকে আইনগত সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এনেক্স-২ তে বলা হয়েছে- মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকার, আদিলুর রহমান খান ও নাসিরুদ্দিন এলান, যারা অধিকার-এর সেক্রেটারি ও ডিরেক্টর, তাদেরকে সেক্রেটারি জেনারেলের ২০১১, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, ২০০৯ সালে ইউপিআর-এর প্রথম দফায় তারা যুক্ত থাকার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। ২০১৩ সাল থেকে অধিকারের স্টাফদের আটক, অভিযোগ, হুমকি, হয়রানি, নজরদারি এবং এর একজন স্টাফকে হত্যার বিষয় আমলে নিতে পেরেছে স্পেশাল প্রসিডিউরস ম্যান্ডেট হোল্ডারস। চিঠিতে বলা হয়, ফরেন ডোনেশন (ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিজ) রেগুলেশন্স বিল-২০১৬ এর অধীনে অধিকারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। ২০২১ সালের ৭ই ডিসেম্বর আদিলুর রহমান খান এবং নাসিরুদ্দিন এলান সংশ্লিষ্ট, ২০১৩ সালে তাদের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধীনে করা মামলার আইনগত বিষয় তারা নজরে রাখে। ২০২১ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর আপিলেট ডিভিশনে রিভিউয়ের আবেদন করা সত্ত্বেও ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজ শুরু করে এবং এখন পর্যন্ত কয়েক দফা শুনানি হয়। এ মামলায় যদি তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় তাহলে আদিলুর রহমান খান ও নাসিরুদ্দিন এলানের সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে উল্লেখ করে চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যে, এতে নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোর কাজ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ও জাতিসংঘের মেকানিজমের সঙ্গে কাজ করার জন্য একই অবস্থার শিকার হতে হবে।

২০২২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ মাধ্যমকে বলে, জাতিসংঘের সুনির্দিষ্ট কিছু বডি বাংলাদেশকে ভুলভাবে গুমের তালিকায় নিয়েছে। এর দু’দিন পরে অধিকার দাবি করে তারা এনজিও বিষয়ক ব্যুরো অফিস থেকে একটি চিঠি পেয়েছে। এতে ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে তারা যেসব জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য ধারণ করেছে, সে বিষয়ে তদন্ত করতে চায়। ওএইচসিএইচআর যেসব তথ্য পেয়েছে সে অনুযায়ী, অধিকার এবং এর স্টাফরা অব্যাহতভাবে নজরদারির মধ্যে আছেন, যা ২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বরের পরে তীব্র হয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে অধিকারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ অবস্থায় ছিল। তাদের নিবন্ধন নবায়নের আবেদনও মুলতবি অবস্থায় ছিল। রিপোর্টিংয়ের সময়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন বডি এবং মেকানিজমের সঙ্গে অব্যাহতভাবে যুক্ত থেকেছে অধিকার। তারা তথ্য দিয়েছে, বিবৃতি দিয়েছে। স্পেশাল প্রসিডিউরসের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। চিঠিতে এসব কেসের বিস্তারিত উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যই জানতে চেয়েছে জাতিসংঘ।