মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

ছেনোয়ারা বেগম (২৪)। পিতা-মৃত ছিদ্দিক আহমদ, স্বামী মৃত আবদুল জলিল। টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়নের পশ্চিম মহেশখালীয়া পাড়ার ম্যারাংখালী গ্রামের বাসিন্দা। মঙ্গলবার ২৮ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার ১৫ তম সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন। তার স্বামী হত্যার লোমহর্ষক বর্ননা প্রদানকালে পুরো আদালতের পরিবেশ অনেকটা থমকে ছিলো। এসময় অনেকে চোখের জল সংবরণ করতে পারেনি। কাটগড়ায় আসামী প্রদীপ কুমার দাশ এর চেহারা ছিলো খুবই বিমর্ষ।

জবানবন্দীতে ছেনোয়ারা বেগম বলেন, তার স্বামী আবদুল জলিল একজন সিএনজি চালক।২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর তার স্বামী যাত্রী নিয়ে মেরিন ড্রাইভ রোড হয়ে কক্সবাজার আসলে সেখান থেকে টেকনাফের পুলিশ কোন কারণ ছাড়া তাকে ধরে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তার স্বামীর তিন মাস যাবৎ কোন খোঁজ খবর না পেয়ে টেকনাফ মডেল থানায় বেশ কয়েকবার লিখিত অভিযোগ করতে যান। কিন্তু টেকনাফ থানা তার কোন অভিযোগ গ্রহন করেনি।

পরে টেকনাফ মডেল থানার দালালের মাধ্যমে ছেনোয়ারা বেগম ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এর সাথে দেখা করে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ তাকে জানায়, তার স্বামীকে জীবিত পেতে হলে তাকে ১০ লক্ষ টাকা দিতে হবে। ছেনোয়ারা বেগম এনজিও ‘আশা’ সহ বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ধার-কর্জ করে দালালের মাধ্যমে ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ৫ লক্ষ টাকা প্রদান করে। তারপরও ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ছেনোয়ারা বেগম এর স্বামী আবদুল জলিলকে ক্রসফায়ার দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেন। আবদুল জলিলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ৭ মাস ৪ দিন পর কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়।

পরে ছেনোয়ারা বেগম জানতে পারেন, একজন মেজরের নেতৃত্বে একটি ভিডিও টিম ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এর এসব অপকর্মের ভিডিও করতেছে। ছেনোয়ারা বেগম মারিশবনিয়ায় তাদের কাছে গিয়ে তার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যার বর্ননা দেন। পরে টেকনাফ মডেল থানা থেকে পোশাক পরা ৫/৬ জন পুলিশ তার বাড়িতে গিয়ে ছেনোয়ারা বেগম থেকে জানতে চায়, তিনি কোন ভিডিও টিমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কিনা? ছেনোয়ারা বেগম পুলিশের কাছে ভিডিও সাক্ষাৎকারের বিষয়ে অস্বীকার করে। পুলিশ তাকে কারো কাছে কোন ভিডিও সাক্ষাৎকার না দেওয়ার জন্য শাসিয়ে চলে যায়। পরে তিনি জানতে পারে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ সহ অন্যান্যরা সেই মেজরকে হত্যা করেছে।

ছেনুয়ারা বেগম সাক্ষ্য দেওয়ার পর ১৫ জন আসামীর পক্ষে তাদের আইনজীবীরা ছেনোয়ারা বেগমকে পৃথক পৃথক ভাবে জেরা করেন।

এছাড়া একইদিন মামলার ১৬ তম সাক্ষী হিসাবে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ছোট হাবির পাড়ার মৃত খলিলুর রহমানের পুত্র হামজালাল আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। সাক্ষী হামজালাল’কে ১৪ জন আসামীর পক্ষে তাদের আইনজীবীরা পৃথক পৃথক ভাবে জেরা করেন। আসামী প্রদীপ কুমার দাশ এর পক্ষে তার আইনজীবী এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত হামজালাকে জেরা করার জন্য আদালতে সময় প্রার্থনা করলে বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বুধবার ২৯ সেপ্টেম্বর জেরা করার জন্য তাকে সময় দেন।

এরপর মামলার ১৭ সাক্ষী টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং এর তুলাতলীর আবুল বশরের পুত্র আলী আকবর এর সাক্ষ্য ও জেরা রাষ্ট্র ও আসামীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘ডিক্লাইন্ট’ করা হয়। অর্থাৎ পূর্ববর্তী সাক্ষী হামজালাল আদালতে যে সাক্ষ্য ও জেরার জবাব দিয়েছেন সাক্ষী আলী আকবরের ক্ষেত্রে একই সাক্ষ্য, একই জেরা করা হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। এনিয়ে চতুর্থ দফা সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথম দিনে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই মামলায় মোট ১৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য আদালতে গ্রহণ করা হলো।

এরআগে আরো ১৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা হলেন-মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সাহিদুল ইসলাম সিফাত, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ আমিন, মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও হাফেজ শহীদুল ইসলাম, আবদুল হামিদ, ফিরোজ মাহমুদ ও মোহাম্মদ শওকত আলী, হাফেজ জহিরুল ইসলাম, ডা. রনধীর দেবনাথ, সেনা সদস্য সার্জেন্ট আইয়ুব আলী, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. মোঃ শাহীন আবদুর রহমান চৌধুরী ও মোক্তার আহমদ।

রাষ্ট্র পক্ষে মামলাটির আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এডভোকেট ফরিদুল আলম, অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট মোজাফফর আহমদ হেলালী, এপিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এসময় বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস এর আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা, এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট মাহবুবুল আলম টিপু, এডভোকেট ফারজানা, এডভোকেট ছৈয়দুল ইসলাম, এডভোকেট এসমিকা সুলতানা প্রমুখ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আসামীদের পক্ষে আদালতে এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, এডভোকেট দিলীপ দাশ, এডভোকেট শামশুল আলম, এডভোকেট মমতাজ আহমদ (সাবেক পিপি) এডভোকেট মোহাম্মদ জাকারিয়া, এডভোকেট চন্দন দাশ, এডভোকেট এম.এ বারী, এডভোকেট ওসমান সরওয়ার শাহীন, এডভোকেট মোশাররফ হোসেন শিমুল, এডভোকেট ইফতেখার মাহমুদ প্রমুখ সাক্ষীদের পৃথক পৃথক ভাবে জেরা করেন।

বুধবার ২৯ সেপ্টেম্বর চতুর্থ দফায় দ্বিতীয় দিনের মতো এই মামলার অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা করা হবে। এছাড়া সাক্ষী হামজালালকে আসামী প্রদীপ কুমার দাশ এর পক্ষে তার আইনজীবী জেরা করবেন।

ছবি : আদালতের অপেক্ষামান কক্ষে সাক্ষী হামজালাল ও আলী আকবর।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার এম. নুরুল কবির জানান-মঙ্গলবাবার ২৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য চার্জশীটের ১৭ নম্বর সাক্ষী সাইফুল আফসার প্রকাশ আব্বুইয়া, ২২ থেকে ২৫ নম্বর সাক্ষী যথাক্রমে অলি আহামদ, হামজালাল, মোঃ আলী আকবর ও ছেনুয়ারা বেগমের কাছে সমন দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, ২৯ সেপ্টেম্বর আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য সালেহ আহমদ, বেবী ইসলাম, নিহত সিনহার মাতা মোছাম্মৎ নাছিমা আক্তার, ফরিদুল মোস্তফা খান ও সার্জেন্ট মোহাম্মদ মোক্তার হোসেনকে সমন দেওয়া হয়েছে।

চার্সজশীটের সাক্ষীরা যথারীতি আদালতে উপস্থিত থাকলেও আসামীদের পক্ষে সাক্ষীদের দীর্ঘ জেরার কারণে সমন পেয়ে হাজির হওয়া সকল সাক্ষীদের সাক্ষ্য নির্ধারিত দিনে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানান-এপিপি ও কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ।

মঙ্গলবার সাক্ষ্য গ্রহণকালে মামলার ১৫ জন আসামীকেও কড়া নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করা হয়। মামলায় কারাগার থেকে এনে আদালতে যে ১৫ আসামিকে হাজির করা হবে, তারা হলো : বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া।প, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

গত ২৩ আগস্ট সকালে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল এর আদালতে মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক এ বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।