তোফায়েল আহমদ , কালেরকন্ঠ :
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রদত্ত সেই জমিখন্ডটি অবশেষে দখলমুক্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় তিন দশক সময় পার হয়েছে। আর এ জমিতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্পের ঘর তৈরি হচ্ছে। এ ঘরে বসবাস করবেন বৃদ্ধা দিলচেহের বেগম (৭৫)। এলাকায় বলাবলি হচ্ছে-এরশাদের দেওয়া জমিতে হাসিনার ঘর, ঘরের বাসিন্দা হবেন দিলচেহের। এখন সেই দিলচেহেরের খুশি আর কে দেখে। তিনি অনবরত বলেই যাচ্ছেন-আমাকে প্রধানমন্ত্রী ঘর দিয়েছেন।

সন্তান-সন্ততি নেই, স্বামীও নেই। এক হতভাগি নারী দিলচেহের বেগম। কক্সবাজারের রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা দিলচেহের। নিঃসন্তান এই নারীর স্বামী আহমদ নবীও মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বসবাসেরও কোনো জায়গা নেই। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের আমলে (১৯৯০ সালের আগে) জোয়ারিয়ানালা গুচ্ছগ্রাম এলাকায় ভূমিহীন দরিদ্র মানুষের জন্য এক খণ্ড করে সরকারি খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

সেই সময় ওই গুচ্ছগ্রামে বরাদ্দ দেওয়া ৪০ পরিবারের ভূমিহীনের মধ্যে দিলচেহেরও ছিলেন। দিলচেহের পেয়েছিলেন আশি শতক (দুই কানি) জমি। সেই জমিতে দিলচেহের একটি ছোট্ট ঘরও তৈরি করেছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রচণ্ড গতির ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘরটি ভেঙে যায়। এর পরবর্তী সময়ে তার স্বামীও মারা যান। অসহায় হয়ে পড়েন দিলচেহের। সারা দিন ভিক্ষাবৃত্তি করে রাতে অন্যের ঘরের আঙিনায় ঘুমিয়ে পড়েন।

এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জোরপূর্বক দখল করে নেয় দিলচেহেরের জমিখন্ডটি। বেলাল নামের ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি সেই জমিতে বাগান করে ফেলেন। কেবল তাই নয় প্রভাবশালী ব্যক্তিটি ছলেকলে দিলচেহেরের জমির দলিলটিও ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। সেই থেকে গত প্রায় তিন দশক ধরে হতভাগি দিলচেহের তার বন্দোবস্তি প্রাপ্ত জমি খন্ডটি ফিরে পাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জমি নেই-ঘর নেই’ কর্মসূচির একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। সেই প্রকল্পে কক্সবাজার জেলায় ২০১টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের জন্য ৩০টি ঘর দেওয়া হয়েছে। জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের ২টি ঘরের মধ্যে একটির উপকারভোগীর তালিকাভুক্ত হয়েছেন দিলচেহের বেগম। উপজেলা প্রশাসন এসব ঘর তৈরির কাজ করছে। প্রতিটি ঘরের জন্য এক লাখ ৭০ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

গত তিন দিন আগে দিলচেহেরের দখলমুক্ত জমিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্পের ঘর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কাজ শুরুর পর থেকেই দিলচেহের আনন্দে আত্মহারা। সারাক্ষণ তিনি ঘরের নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। দিলচেহের আজ বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন-‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। আমার কেউ নেই। মহান আল্লাহর দরবারে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া কামনা করছি।’ দিলচেহের বলেন, দখলবাজ বেলাল তার জমির দলিল নিয়ে গেছে। সেই দলিল তিনি ফেরৎ চান। এজন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চান তিনি।

এদিকে দিলচেহেরের ঘর প্রাপ্তি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন (DC Cox’sBazar) তাঁর সরকারি ফেসবুক আইডিতে একটি স্বচিত্র পোস্ট দেন।

সেই পোস্টে জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেন- ‘রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের দিলচেহের। স্বামী মৃত নবী, ঠিকানা-জোয়ারিয়ানালা গুচ্ছগ্রাম, রামু। পৃথিবীতে আপন কেউ নেই। পেশায় ভিক্ষুক। দীর্ঘ ৩০ বছর আগে তিনি সরকার থেকে একটি খাস জমি বন্দোবস্তি পান। কিন্তু এই সমাজেরই কিছু প্রভাবশালী মানুষ জোরপূর্বক তার জমি দখল করে। এরপর বিভিন্ন দুয়ারে তিনি ঘুরেছেন, কিন্তু কোনো সমাধান পাননি। আজ উপজেলা প্রশাসন রামুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও জেলা প্রশাসন, কক্সবাজারের সার্বিক তত্বাবধানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসাবে একটি ঘর পাচ্ছেন।’

জেলা প্রশাসকের ফেসবুক আইডির পোস্টে চাওর হয়ে পড়ে অভাগী দিলচেহেরের পাওয়া-নাপাওয়ার ইতিবৃত্ত। সেই সঙ্গে একটি সরকারের প্রদত্ত জমির জবরদখল থেকে শুরু করে সর্বশেষ বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ‘মুজিববর্ষে বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ কর্মসূচির চলমান পদক্ষেপ।

এ বিষয়ে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা কালের কণ্ঠকে বলেন- ‘হতভাগি বৃদ্ধা দিলচেহেরের ভূমির দখলবাজ বেলালকে উচ্ছেদ করেই সেই জমিতে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচির আওতায় ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘর নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

স্থানীয় জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল শামসুদ্দিন প্রিন্স জানান, দুঃখজনক বিষয়টি হচ্ছে- বৃদ্ধা দিলচেহেরের দখল হওয়া জমিটি ফিরে পেতে প্রায় তিন দশক সময় লেগেছে। তবে সবচেয়ে সুখের খবর হচ্ছে- ‘রাষ্ট্রপতি এরশাদ দিলচেহেরকে জমি দিয়েছেন, আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই জমিতে দিলচেহেরের জন্য দিয়েছেন একটি ঘর।’