শাহেদ মিজান, সিবিএন:

মহেশখালী উপজেলার কালামারছড়া ইউনিয়নের উত্তর নলবিলায় স্বামীর হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন আফরোজা বেগম নামে এক গৃহবধূ। খুন করে মাটিতে পুঁতে রাখার পাঁচদিন পর শনিবার গভীর রাতে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এই নির্মম হত্যার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। এই নিন্দীয় হত্যার বিচার চেয়ে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সর্বত্র।

আফরোজার পরিবার এবং পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ অক্টোবর হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায় আফরোজা। কিন্তু তার এই নিখোঁজ রহস্যময় ঠেকে। কারণ তার নিখোঁজের সাথে সাথে পালিয়ে যায় তার স্বামী বদরখালী কলেজের প্রভাষক রাকিব হাসান বাপ্পী। এই নিয়ে বড় অঘটনের সন্দেহ হয় আফরোজার বাবার পরিবারের। তারা হন্য হয়ে খুঁজেও সন্ধান পায়নি তাার। এর মধ্যে পুলিশও অনুসন্ধান চালিয়ে ব্যর্থ হয়। তবে শেষ মুহূর্তে ঘাতক রাকিব হাসান বাপ্পীর তালাক দেয়া আগের স্ত্রীর মেয়ে জারার স্বীকারোক্তি মতে শনিবার (১৭ অক্টোবর) রাতে বাপ্পীর বাড়ির আঙিনার গর্ত থেকে আফরোজা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সবাই ঘাতক বাপ্পীসহ এই হত্যার সাথে জড়িত তার পরিবারের সদস্যদের শাস্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে।

অপকর্মের আতুড়ঘর ‘হাসান বশির পরিবার’: স্থানীয় সূত্রে জানা যায় উত্তর নলবিলার বহুল সমালোচিত ব্যক্তি হাসান বশির। এক সময় নিজেই ছিলেন নানা অপরাধের হোতা। দীর্ঘদিন তিনি আলোচিত নলবিলার সড়ক ডাকাতির নেতৃত্বে ছিলেন। গড়ফাদারের ভূমিকায় থেকে বহু বছর সড়কে গাড়ি ডাকাতি করে বহু মানুষকে নিঃস্ব করেছেন। একই সাথে নিজের অস্ত্রবাজি, লালিত বাহিনী দিয়ে চিংড়ি প্রজেক্ট, মানুষের জমি দখল, সরকারি পাহাড় দখল করে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এসব ঘটনায় হাসান বশিরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।

স্থানীয় লোকজন দাবি করেন, বয়স পড়ে যাওয়ায় এবং দুই স্ত্রীর ছেলেরা বড় হওয়ায় হাসান বশির ‘বিশ্রামে’ চলে যায়! এরপর পিতার ছেড়ে দেয়া ‘মাঠে’নামে তার পুত্ররা। হাসান বশিরের দুই স্ত্রীর রয়েছে পাঁচ পুত্র। এর মধ্যে তিনপুত্র একেবারে বখে যায়। তারা হলেন, প্রথম স্ত্রীর দুই পুত্র হাসান আরিফ ও হাসান রাসেল এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র রাকিব হাসান বাপ্পী। দ্বিতীয় স্ত্রীর অন্য দুই পুত্র চাকরি নিয়ে এলাকার বাইরে থাকলেও বখে যাওয়া তিন পুত্র এলাকায় অপকর্মের রাজত্ব কায়েম করে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে হাসান আরিফ, হাসান রাসেল এবং রাকিব হাসান বাপ্পী বেপরোয়া হয়েছে। আওয়ামী পরিবার হলেও হাসান রাসেল কিন্তু যুবদল নেতা। কিন্তু তিনিও এই সরকারের ছত্রছায়ায় নানা অপরাধ কার্যক্রম শুরু করে।

অনুসন্ধান করে জানা যায়, এই পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা কারবারের সাথে জড়িত। অন্য দুই ভাই পরোক্ষভাবে থাকলেও এই ইয়াবা কারবারের নেতৃত্বে দেন হাসান রাসেল। তাদের ইয়াবা কারবারের রয়েছে একটি বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্য রয়েছে মহেশখালী থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কথিত রয়েছে, কয়লাবিদ্যুতের মালামাল নিয়ে আসা গাড়িতে করে ইয়াবা পাচার করতো হাসান রাসেলের সিন্ডিকেটে। এক পর্যায়ে ২০১৭ সালের বিপুল ইয়াবা নিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলো হাসান রাসেল। দীর্ঘদিন জেল কেটে বের হওয়ার পর আবার ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ে। ইয়াবা ব্যবসা করে বিপুল টাকা এবং শাপলাপুর, হোয়ানক, কালারমারছড়া ও মাতারবাড়িতে বেশ পরিমাণ জমি কিনেছে হাসান রাসেল।

এদিকে ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি পদ ভাগিয়ে নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে হাসান আরিফ। জড়িয়ে পড়ে নানা অপকর্মে। এর মধ্যে রয়েছে, বদরখালী-মহেশখালী সেতুর নিচ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, চালিয়াতলিতে রাতের আধাঁরে বালুরডেইল নামক সরকারি বালু মহাল থেকেত বালু বিক্রি ও বিভিন্ন ডাম্পার থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করেন। এতে তার সহযোগী হিসেবে রয়েছে উপজেলা যুবলীগের সদস্য আজিজুর হাসান রনি, বদিউল আলম বদি, সিরাজ, শহীদুলসহ আরো কয়েকজন। চালিয়াতলীসহ বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কেটে প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করে মাটি বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকার অবৈধ আয় করেছেন। অবৈধ ভাবে জনতাবাজার দখল করে চাদাঁবাজি করেন। এতে সহযোগী উপজেলা যুবলীগের সদস্য আজিজুর হাসান রনি, শিমুল, একরাম, হেলাল রুবেলসহ আরো কয়েকজন। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যুবলীগের নাম দিয়ে টেন্ডারবাজি। তার ব্যবসায়িক পার্টনারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ও রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ। এতে অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
অন্যদিকে আফরোজার ঘাতক বাপ্পী একজন প্রভাষক হলেও মাদক সেবন করে নিয়মিত। মাদক সেবন করে স্ত্রীকে বর্বর নির্যাতন করে। তার নির্র্যাতন সহ্য করতে না পেরে ইতোমধ্যে তিন স্ত্রীর সাথে তার ডিভোর্স হয়েছে। ওইসব স্ত্রীরা অনেকটা তার থেকে পালিয়ে রক্ষা পায়! কিন্তু রক্ষা হয়নি হতভাগী আফরোজার। নিষ্ঠুর বাপ্পীর হাত থেকে বাঁচতে পারেনি আফরোজা। খুব নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে।

অভিযোগ রয়েছে, অস্ত্রবাজি, রাজনৈতিক প্রভাব, সন্ত্রাসী বাহিনী লালন, রাজনৈতিক আশ্রয়সহ নানাভাবে দীর্ঘদিন পুরো উত্তর নলবিলাকে জিম্মিকে করে রেখেছে হাসান বশিরের পরিবার। তাদের কারণে সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এভাবেই এই পরিবারটি একটি বিশাল এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে দাবি করেন সাধারণ মানুষ।