ভোরের কাগজঃ

আর কদিন পরেই দ্বিতীয়বারের মতো মা হতেন তিনি। অনাগত সন্তানের প্রতীক্ষায় কাটছিল তার মধুময় প্রহর। কিন্তু সেই আনন্দক্ষণের দেখা পেলেন না শারমিন আক্তার শাপলা (৩২)। ডেঙ্গুর ছোবলে নিভে গেল তার জীবনপ্রদীপ। গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই সন্তানসম্ভবা নারী। শুধু শাপলাই নন, প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ফিরোজ কবির স্বাধীন, অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দীন কোরেসীর স্ত্রী সৈয়দা আক্তার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের স্ত্রী এবং শিক্ষক ফারজানা হোসেন টুকু, চিকিৎসক তানিয়া সুলতানাসহ সরকারি হিসাবে গতকাল পর্যন্ত এই ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ১৮ জন। তবে বিভিন্ন হাসপাতাল ও বেসরকারি হিসাবে এতে মৃতের সংখ্যা ৫৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়, রবিবার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দুই হাজার ৬৫ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় এ সংখ্যা ছিল ১,৮৭০। আর চলতি মাসের প্রথম পাঁচ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ৯ হাজার ৬-এ।
সারা দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে ভয়াবহ মাত্রায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি মহামারির পর্যায়ে। তবে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর ঘটনা বিবেচনায় নিলে ডেঙ্গু এখনো ব্যাপক প্রাণঘাতী রূপে আবিভর্‚ত হয়নি। তা সত্তে¡ও এডিস মশাবাহিত এই রোগ নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র আতঙ্ক। অন্য রোগে এর চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যুও এতটা আতঙ্ক ছড়ায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা নিধনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা এবং ওষুধ আমদানির ক্ষেত্রে দীর্ঘ অনিশ্চয়তাই ডেঙ্গু ঘিরে জনআতঙ্কের মূল কারণ। গভীর উদ্বেগের সঙ্গে সবাই ভাবছে, এই বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
এ ব্যাপারে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, তথ্যের গরমিল এবং তথ্য লুকিয়ে রাখার প্রবণতা, ডেঙ্গু জ্বরে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে সরকারি ভাষ্য ও বেসরকারি সূত্রের তথ্যে গরমিল দেখছেন মানুষ। এ ছাড়া চারপাশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি, হাসপাতালগুলোতে তিলধারণের ঠাঁই নেই। অতিরিক্ত আইজিপির স্ত্রী, স্বাস্থ্য উপসচিবের স্ত্রী, আবহাওয়াবিদের স্ত্রী, সিভিল সার্জন, চিকিৎসক, মেধাবী শিক্ষার্থীসহ অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। এসব মৃত্যু মানুষকে নাড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে মন্ত্রীদের নানা মন্তব্য, মেয়রদের বাকচাতুরি মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শুধুই কথার ফুলঝুরি। রাজধানী ছেড়ে মশা এখন সারা দেশ গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে গেছে।
লেনিন চৌধুরী বলেন, এবার ডেঙ্গু জ্বরের ধরন পাল্টেছে। আগে ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম লক্ষণ ছিল শরীরে র‌্যাশ থাকা। কিন্তু এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে র‌্যাশ দেখা যাচ্ছে না। জ্বর হওয়ার পরও চিকিৎসকরা বুঝতে পারছেন না। হেমোরেজিক ডেঙ্গু এবার বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি থাকায় বেশি মৃত্যু হচ্ছে। শক সিনড্রোম এটি আতঙ্কের অন্যতম কারণ।
ডেঙ্গু বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কম-বেশি রয়েছে; কিন্তু সমন্বিত প্রতিরোধের কারণে আমাদের দেশে আতঙ্কটা বেশি ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, যে কোনো রোগেই মহামারি হলে আতঙ্ক ছড়াতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের উচিত আতঙ্ক না ছড়িয়ে সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করা। বাস্তবভিত্তিক কাজ করা। সরকার-রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সব সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী।
এদিকে রাজধানীতে চলতি বর্ষায় এডিস মশার সংখ্যা বেড়েছে ১৩ গুণের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই জরিপটিও জনআতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে দুই সিটির দায়িত্ব নিয়ে। মশা মারার কোনো পদক্ষেপই তারা কেন নেননি এতদিন? এ ব্যাপারে সাংস্কৃতিক কর্মী ডালিয়া দাস ভোরের কাগজকে বলেন, কেন যেন দুই সিটির মধ্যে এক ধরনের রশি টানাটানি শুরু থেকেই চোখে পড়ার মতো। দুই সিটির কাজের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। নেই প্রতিষেধক। নেই সঠিক দিকনির্দেশনা। ডেঙ্গু হয়নি এমন রোগীকেও টেস্ট দেয়া হচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে একটা প্যানিক সৃষ্টি হয়ে গেছে।
ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কে আছি উল্লেখ করে তৈরি পোশাক শিল্প মেট্রো নিটিং এন্ড ডায়িংয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার অমিত কে বিশ্বাস ভোরের কাগজকে বলেন, ডেঙ্গু মোকাবেলায় সম্মিলিত কোনো উদ্যোগ না থাকাই আতঙ্কের মূল কারণ। দুই সিটি করপোরেশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় নেই। অভিভাবক হিসেবে সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি। এক সপ্তাহ ধরে ছেলেকে স্কুলে দেই না। কারণ সন্তানের সুস্থতা আমার কাছে বেশি জরুরি। কিন্তু বাড়িতেও যে সুস্থ থাকবে এই গ্যারিন্টি কে দেবে?
ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন ৮৬ জন : প্রতিদিনই আগের রেকর্ড ভেঙে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ঘণ্টায় এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ৮৬ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার এন্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৬৫ জন। চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২৭ হাজার ৪৩৭ জন। এদের মধ্যে মারা গেছেন ১৮ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৭ হাজার ৬৫৮ জন। চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি গেছেন ১৯ হাজার ৭৬১ জন। তবে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সরকারি হিসাবের সঙ্গে গণমাধ্যমের হিসাবের পার্থক্য বিশাল। বিভিন্ন গণমাধ্যমের হিসাবে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৯ জন। এর মধ্যে গতকাল সোমবারই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬ জন।
এদিকে গতকাল মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। ডেঙ্গু নির্মূল করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, সচেতন না হলে ডেঙ্গুর বিস্তার আরো বেশি হতে পারে। এ জন্য জনগণ এক হয়ে এ রোগ নির্মূলে কিছু না কিছু অবদান রাখছে।
অন্যদিকে ডেঙ্গু প্রকোপ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় এই রোগ পরীক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণের সংকট দেখা দেয়ায় তা আমদানির উপর সব ধরনের শুল্ককর ছাড় দিয়েছে সরকার। গতকাল সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই সুবিধা বলবৎ থাকবে।
৬ জনের মৃত্যু : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সোমবার ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার স্কুলছাত্রী অথৈ সাহা (১১), ভোর সাড়ে ৫টায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ কে এম নাজমুল হকের অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী শারমিন আরা শাপলা (৩২), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরমালিপা গ্রামের হাসান (১৩), মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রিপন হাওলাদার (৩২), কুমিল্লার কাটানিসা গ্রামে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আনোয়ার হোসেনকে ঢাকায় আনার পথে এবং খুলনার সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খাদিজা বেগমের মৃত্যু হয়।
অভিযান ও জরিমানা অব্যাহত : নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে মশা প্রতিরোধী মলম ওডোমাসের দাম বেশি রাখায় গতকাল রাজধানীর গুলশান-২ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ল্যাভেনডারকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এর আগে একই অপরাধে রাজধানীর পাঁচ ফার্মেসিকে জরিমানা করে ভেক্তা অধিদপ্তর।
অযথা আতঙ্কিত হয়ে ডেঙ্গু টেস্ট না করার পরামর্শ : অযথা আতঙ্কিত হয়ে ডেঙ্গু টেস্ট না করার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় প্রয়োজন। অকারণে চাপ বাড়ালে যারা সত্যিই খুব অসুস্থ তাদের সেবা বিঘ্ন ঘটবে। এ জন্য অযথা আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে টেস্ট করতে হবে। এ সময় তিনি জানান, ঈদে সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি রয়েছে। ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনার জন্য সব জেলা হাসপাতালে ১০ লাখ ও উপজেলা পর্যায়ে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে ত্বরিত চিকিৎসা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।