মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের শীর্ষ তালিকাভুক্ত টেকনাফের নুরুল হক প্রকাশ ইয়াবা ভূট্টোর ২ টি আলিশান বাড়ি ও ভূমি সহ প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করতে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ এবং সিনিয়র স্পেশাল জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজের দেয়া আদেশ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা ইয়াবাবাজ নুরুল হক ভুট্টোর আবেদন সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন। মঙ্গলবার ২৫ জুন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে.এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্টের দ্বৈতবেঞ্চ এ খারিজ আদেশ দেন। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের চীফ প্রসিকিউটর সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট খুরশীদ আলম খান সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন।
মামলাটির গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে ত্রীপক্ষীয় শুনানীতে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ.কে.এম আমিন উদ্দিন মানিক। আর নুরুল হক ভুট্টোর পক্ষে ছিলেন এডভোকেট প্রবীর রঞ্জন হালদার। দুদকের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট খুরশীদ আলম খান।
হাইকোর্টের এ আদেশের ফলে নুরুল হক ভুট্টোর বাড়ি ও সম্পদ কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজের আদেশ মতে জব্দই থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।
মঙ্গলবার ২৫ জুন হাইকোর্টে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রব। মতামতে বলা হয়েছে সিআইডি এই (মানিলন্ডারিং) মামলার তদন্ত করতে পারবে। এর আগে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নির্দেশে জব্দ করা দুটি বিলাসবহুল বাড়ি ও সম্পদ সহ। ৩০ কোটি টাকার সম্পদ ছাড়িয়ে নিতে হাইকোর্টের আবেদন করে টেকনাফের আলোচিত ইয়াবাবাজ নুরুল হক ভুট্টো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের একাধিক তালিকায় থাকা টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবাবাজ নুরুল হক ভুট্টো সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত।
হাইকোর্টে ভুট্টোর আবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক সাংবাদিকদের বলেন-অর্থপাচার প্রতিরোধ আইনে করা এক মামলার তদন্তে নুরুল হক ভুট্টো ও তার পরিবারের অবৈধ সম্পদের তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (ইকোনমিক ক্রাইম স্কোয়াড) এর সহকারি পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট টেকনাফ থানায় নুরুল হক ভুট্টো, তার বাবা, স্ত্রী, ভাইসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় পুলিশের আবেদনে গত ৫ মার্চ কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজ এক আদেশে ভুট্টোর পরিবারের সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশে পুলিশ মামলায় বর্ণিত সম্পদ জব্দ করে। সেই থেকে এই সম্পদ জব্দ করা অবস্থায় রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী আরও বলেন-টেকনাফ থানায় যেদিন মামলা হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৯ আগষ্ট পুলিশ সেদিনই নুরুল হক ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি গত বছর ২৮ মার্চ হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন। এরপর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দীর্ঘদিন নিম্ন আদালতে হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দাখিল করেছেন। আর এই মামলার আসামি ভুট্টোর ভাই নুর মোহাম্মদ গত ২১ মার্চ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিন কথিত বন্ধুক যুদ্ধে নিহত হয়। ২০০৯ সালে নুরুল হক ভূট্টো রিক্সা ভ্যান চালাতেন। পরে সে ২ টি বিলাসবহুল বাড়ি ও প্রায় ২৬ কোটি টাকার ভূমি ক্রয় করে।
আদালতের নির্দেশে টেকনাফে ইয়াবাবাজ ভূট্টো ও তার পিতা এজাহর অবৈধভাবে অর্জিত প্রায় ৩০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কক্সবাজার পুলিশ সুপারের পক্ষে টেকনাফ থানা পুলিশ ক্রোক ১ জুন সকাল ১০ টা হতে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাশ-বিপিএম(বার) এর নেতৃত্বে একদল পুলিশ এক সাড়াশি অভিযান চালিয়ে ইয়াবাবাজী করে অর্জিত এ অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে ক্রোক করেন। ক্রোককৃত সম্পদের মধ্যে দু’টি আলিশান দালান, ৮ টি পৃথক তফশীলের মূল্যবান জমি রয়েছে। ওসি প্রদীপ কুুমার দাশ বিপিএম(বার) এর প্রাথমিক ধারণা মতে, শনিবার দীর্ঘ ৫ ঘন্টা অভিযান চালিয়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে ক্রোককৃত সম্পদের মূল্য ৩০ কোটি টাকা থেকে ৩৫ কোটি টাকা হতে পারে। সুরম্য দালান ও জমি গুলো আদালতের রায় অনুযায়ী পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হয়ে হয়েছিল এবং অস্থাবর সম্পদ সমুহ সিজারলিষ্ট করে শনিবার থানার গোডাউনে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের স্পেশাল জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজ পিতা, ২ পুত্র সহ তিনজন ইয়াবাবাজের মানিলন্ডারিং করে অবৈধভাবে অর্জিত ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৭ টাকার সম্পদ ক্রোক করার জন্য গত ৫ মার্চ এ যুগান্তকারী এই আদেশ দিয়েছিলেন। যেসব ইয়াবাবাজের সম্পদ ক্রোক করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা হলো-টেকনাফ উপজেলার নাজির পাড়ার এজাহার মিয়ার ২ পুত্র নুরুল হক ভূট্টো ও নুর মোহাম্মদ এবং তাদের পিতা নজু মিয়ার পুত্র এজাহার মিয়া। তারা তিন জনই পিতা পুত্র। আদালতের এই রায়টি কার্যকর করার মাধ্যমে ইয়াবাবাজদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ক্রোক করা শুরু হলো।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে প্রকাশ, টেকনাফ মডেল থানার ২৯ আগষ্ট ২০১৭ সালের ৭৪ নম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়েরকৃত মামলার এজাহারের ১ নম্বর আসামী নুরুল হক ভূট্টো, ২ মম্বর আসামী নুর মোহাম্মদ ও ১০ নম্বর আসামী পলাতক এজাহার মিয়া ২০১০-২০১১ সাল হতে ২০১৭-২০১৮ সাল পর্যন্ত মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে প্রচুর পরিমানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব সম্পদের মধ্যে দালানকোঠা, ভূসম্পত্তি রয়েছে। যার মূল্য ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৭ টাকা। এসব অবৈধ সম্পদ ক্রোক করে রাষ্ট্রের হেফাজতে নিয়ে আসার জন্য ক্রোকের অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ পুলিশের অর্গানাইজড ক্রাইম (ইকোনোমিক ক্রাইম স্কোয়াড) এর বিশেষ সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ নাজিম উদ্দিন আল আযাদ।
কক্সবাজারের স্পেশাল জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজের আদালতে গত ২৭ জানুয়ারি ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইনের ১৪(১) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার ক্রিমিনাল পারমিশন মিচ মামলা নম্বর হচ্ছ-৫৭৭/২০১৯ ইংরাজি। মামালার ফৌজদারি আবেদনে মাদক ব্যবসা ও ইয়াবা বিক্রয় করে অর্জিত এসব অবৈধ সম্পদ ক্রোক করা নাহলে, এসব অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের আর্থিক করতে পারে। অন্যত্র বিক্রি হতে পারে। তাই এসব অবৈধ সম্পদ ক্রোকের অনুমতি দিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে তত্ত্বাবধারক নিয়োগ দেয়ার জন্য মামলার আবেদনে প্রার্থনা করা হয়। মামলা দায়েরের পর আদালত সম্পদের তফশিল, বিস্তারিত বিবরণ সহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা ও এএসপি মোঃ নাজিম উদ্দিন আল আযাদকে নির্দেশ দেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা গত ২০ ফেব্রুয়ারি সম্পদের স্থির চিত্র, সম্পদের রেজিস্ট্রাড দলিল, সহিমুহুরী অবিকল কপি, খতিয়ান, অবস্থান, চৌহদ্দি, তফশিল, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়ন পত্র, মামলার সমর্থনে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট, তথ্য, উপাত্ত সহ বিস্তারিত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। গত ৫ মার্চ মামলাটি স্পেশাল জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজের আদালতে চুড়ান্ত শুনানী করা হয়। শুনানী শেষে আদালত তফশীলে বর্ণিত অবৈধ স্থাবর অস্থাবর সম্পদ অন্যত্র বিক্রি, হস্তান্তর ও বেহাত হওয়ার আশংকা থাকায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মন্ঞ্জুর করে টেকনাফ মডেল থানার ৭৪/২০১৭ নম্বর মূল মামলা নিষ্পত্তি নাহওয়া পর্যন্ত ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ১৪(১) ধারায় তফশিলে বর্ণিত সমুদয় সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছিলেন। স্পেশাল জজ খোন্দকার হাসান মোঃ ফিরোজের দেয়া আদেশ মতে, একই আইনের ১৪(৩), উপবিধি (১) অনুযায়ী উক্ত অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তির সরকারি গেজেট প্রকাশ করা হয় এবং একটি বহুল প্রচারিত বাংলা জাতীয় দৈনিক ও একটি জাতীয় ইংরাজি দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। আদালত কক্সবাজার জেলা রেজিস্টারকে এসব সম্পত্তি আদালতের অনুমতি ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় নাকরার নির্দেশ দেন। আদেশের কপি তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র বিশেষ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ নাজিম উদ্দিন আল আজাদ ও কক্সবাজারের জেলা রেজিস্টারের নিকট কপি প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে, কক্সবাজারে পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম বলেন-সরকারের “মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স” নীতি অবলম্বনে ইয়াবাবাজদের সকল সম্পদ তদন্ত করে পুলিশের সিআইডি’র ইকনোমিক ক্রাইম স্কোয়াড, এনবিআর, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সহ রাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুর্নীতিদমন কমিশন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ হাইস্কুল মাঠে আত্মসমর্পণকারী ১০২ জন ইয়াবাবাজদের কাছ থেকে সম্পদের হিসাব চাওয়া শুরু করেছে।