চট্টগ্রাম সংবাদদাতা:

চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলায় দুটি বড় প্রকল্পে সড়ক প্রশস্তকরণ ও সেতু নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

সড়ক ও জনপদ বিভাগের অধীনে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কতৃক বাস্তবায়ন করা প্রকল্প হলো মইজ্জ্যারটেক আখতারুজ্জামান চত্বর হতে পুরাতন ব্রীজঘাট-বিএফডিসি সড়ক, অন্য প্রকল্পে মইজ্জ্যারটেক চৌরাস্তা মোড় হতে বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সেতু কালারপুল পার হয়ে কয়েকটি সড়কের কাজে ব্যাপক ব্যতিক্রম ও যেনতেন ভাবে পাথরের পরিবর্তে ইটের খোয়া, মাটির পরিবর্তে নদীর বালি দিয়ে কাজ হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় জনগণ।

এমনকি কাজের মান ও প্রকল্পের যাবতীয় ব্যয় নিয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করে কাজ করা হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিঃ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

পরে দোহাজারী সড়ক ও জনপদ উপ-বিভাগের ওয়াক এ্যাসিসট্যান্টরা তথ্য দিলেও তাতেও রয়ে যায় নানা ফাঁক ফোকর। যা দেখে রহস্য আরো বেড়ে যায়, কি ঘটছে তাহলে এসব বড় বড় প্রকল্পে! তাহলে কি সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে চলছে পুকুরচুরির মহোৎসব। যদিও এসব বিষয় অস্বীকার করেছে দোহাজারী সওজ বিভাগ।

প্রকল্প প্রস্তাবনা ও দোহাজারী সড়ক ও জনপদ উপ-বিভাগের দেওয়া তথ্য সুত্রে জানা যায়, বর্তমানে সড়ক উন্নয়নে কর্ণফুলীতে পুরোদমে দুটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। যথাক্রমে-কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জ্যারটেক চৌরাস্তার মোড়-বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সেতু কালারপুর ১ কিঃ মিঃ সড়ক সম্প্রসারণ, যেখানে ৮ ইঞ্চি উচু বেড তৈরী ও দুপাশে তিন ফুট বর্ধিত করে ১২ ফুট হতে ১৮ ফুটে সড়ক উন্নতিকরণের কথা জানান সওজ অফিস।

একই প্রকল্পে সেতুর ওপারে কোঁলাগাও ইউনিয়নের লাখেরা-মুন্সিরহাটে টালাই করা দুটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ এবং পটিয়া পাঁচুরিয়া-কালুরঘাট সড়ক সংস্কার, বোয়ালখালী গোমদন্ডী-কানুনগো পাড়া সড়ক প্রশস্তকরণ ও রির্টানিং ওয়াল তৈরীর কাজ চলছে। এতে ১৬ কিলোমিটার সড়কের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা। যৌথভাবে এ প্রকল্পের কাজ করছেন তিনটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান-রানা বির্ল্ডাস প্রাইভেট লিঃ, হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিঃ ও তাহের বির্ল্ডাস লিঃ।

এছাড়াও দ্বিতীয় বৃহৎ প্রকল্পে ‌উপজেলার মইজ্জ্যারটেক (বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু) চত্বর থেকে পুরাতন ব্রিজঘাট ফেরিঘাট সড়ক-বিএফডিসি সড়ক-আরবান আলী সড়ক পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সড়কের দুপাশে প্রশস্ত করা হচ্ছে এবং এ সড়কে থাকা দুটি পাকিস্থান আমলের পুরাতন সেতু ভেঙে নতুন ভাবে দুটি পাকা সেতু নির্মাণ করার প্রস্তুুতি কাজ চলছে।

তথ্যমতে, সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৩২ মিটার ও ৩৬ মিটার, প্রস্থ ১০ দশমিক ২৫ মিটার । মইজ্জ্যারটেক থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কের প্রশস্ত হবে বর্তমানে থাকা ১৮ ফুট হতে ২৪ ফুটে উন্নতিকরণ। বাকি দুই কিলোমিটার সড়ক হবে ১২ফুট হতে ১৮ ফুটে বর্ধিত করা।

সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এ সড়কের প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা প্রায়। যে প্রকল্পের কাজের সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়েছে আগামী ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। জয়েন বেঞ্চে এ প্রকল্পেরও কাজ করছেন তিনটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান-রানা বির্ল্ডাস প্রাইভেট লিঃ, হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিঃ ও সালেহ আহমেদ জে.বি।

তথ্য পাওয়া যায়, সওজের তালিকার দশম স্থানে থাকা হাসান টেকনো বিল্ডার্স লিমিটেড এর বিরুদ্ধে এর আগেও টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক সম্প্রসারণ কাজে ধীরগতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিলো।

এদিকে কর্ণফুলী উপজেলার অতি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের এসব কাজ দেখে স্থানীয় অনেকে মনে করেছেন প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং গুণগত মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অবহেলা করা হচ্ছে। কাজ তদারকি করার জন্য পরামর্শক হিসেবে কোনো নিভর্রযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করা হয়নি। জনগণের ধারণা, জবাবদিহিতা না থাকায় প্রকৌশলী ছাড়া রাতের আধারে কিংবা ভোরে হেলপার, মিস্ত্রী ও দিনমজুর দিয়ে সারা হচ্ছে বহু কোটি টাকার সড়ক সংস্কারের কাজ। যদিও অনেক প্রকল্পে পরামর্শকের জন্য প্রকল্পে টাকার সাথে সংস্থান ধরা হয়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চুয়েট এর প্রকৌশলী মো. রাশেদ বিনতে কামাল বলেন, ‘সড়ক নির্মাণের সময় বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সাথে জনপ্রতিনিধিদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকে। তাদেরই উচিত ঠিকাদারদের দিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজটি আদায় করে নেয়া। নজরদারি যদি সঠিকভাবে না হয়, তাহলে ঠিকাদার ফাঁকিবাজি বা নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ নেবেই। অনেকে আবার এসব উচ্চ বিলাসী বরাদ্দ দেখে বলছেন, এসব হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অর্থের লুটপাট। উন্নয়নের নামে পুকুরচুরি! এসব তদারকি করতে দুদকের নজরধারী বাড়ানো উচিত।

এমনকি খোদ সড়ক ও জনপদ বিভাগের লোকজন প্রকাশ্যে কাজের অনিয়ম দেখেও কথা বলছেনা। আমাদের প্রতিবেদক পর পর তিনদিন দুটি প্রকল্পের কাজ দেখতে গেলে তিন দিনেই কাজের সময় কোন প্রকৌশলী বা প্রকল্প কর্মকতার্র দেখা পাননি। প্রকল্পে সুবিধাভোগী অনেকে আবার নাম প্রকাশ না করা সত্ত্বে জানায়, সড়ক ও জনপদ বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাঁজসে এসব অনিয়ম চলছে।

সরেজমিনে আরো দেখা মিলে, রাস্তার কাজে মাটির পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে নদী নালার বালি। মানসম্মত পাথর ব্যবহার না করে প্রকল্প এলাকার আশেপাশ হতে ‘মাটি পাথর’ সংগ্রহ করে তা ব্যবহার হচ্ছে রাস্তার কাজে। সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া নতুন উপজেলায় এসব কাজ দেখে দিনে দিনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে কর্ণফুলীবাসী।

গত ৫ মে চরলক্ষ্যা এলাকায় সরজমিনে রাস্তার কাজ দেখতে গিয়ে সওজের কাজে বালি আর ইটের খোয়া দেখে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ নিজেও অবাক হন এবং জনগণের অভিযোগ গুলোর সত্যতা খুঁজে পান। পরে সাময়িক কাজ বন্ধ রেখে ঠিকাদারদের তলব করেন তিনি।

চরপাথরঘাটা, চরলক্ষ্যা ও শিকলবাহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানেরা বলেন, এসব উন্নয়ন কাজে আমাদের কোন সম্পৃক্ততা নেই। তাই এই ব্যাপারে আমরা কিছু জানিনা।।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দোহাজারী সড়ক ও জনপদ বিভাগের পটিয়া উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘একচুয়েলি আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সঠিক নয়। সিডিউল অনুযায়ী রাস্তার নির্মাণ কাজ চলছে। কোথাও নিম্নমানের কাজ হচ্ছেনা বিষয়টি অনেকে না বুঝে সমালোচনা করছে। অফিসে আসলে বিস্তারিত বুঝানো যেত।’

দু প্রকল্পের বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব ফারুক চৌধুরী জানান, ‘রাস্তায় কাজের মান খুবই খারাপ রাস্তা দু’টি সড়ক ও জনপথ বিভাগের হলেও উপজেলা পর্যায়ে এ বিভাগে কোন দাপ্তরিক লোকবল নেই । প্রতিটি কাজ শুরু হওয়ার আগে কত টাকা বরাদ্দের কাজ, ঠিকাদারের নাম ও কাজের বিবরণ সম্বলিত বিলবোর্ড থাকা দরকার কিন্তু এক্ষেত্রে ঠিকাদারেরা কোন নিয়ম নীতি মানছেনা।’

অনিয়মের বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ জানান, ‘দুই প্রকল্পের কাজ নিয়ে জনগণের কাছ থেকে অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ তদারকির জন্য অফিসার না থাকায় উপজেলায় কাজ করা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গুলো সে সুযোগটা নিচ্ছে। তারপরেও নি¤œমানের কাজ হলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানসহ এর সাথে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’