সিবিএন ডেস্ক:
কক্সবাজার-ঢাকা-কক্সবাজার, অসাধু বাস চালকদের কাছে এটি একটি লোভনীয় রুট। কারণ ইয়াবা আর কাঁচা টাকা। দেশের সকল নামিদামি ও বিলাসবহুল পরিবহনের চালকরা এই রুটে গাড়ি চালাতে চান। তারা সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন ইয়াবা। চালান সরবরাহের বিনিময় পান মোটা অংকের টাকা। গাড়িচালক পেশাকে সামনে রেখে এভাবেই মাদক সম্রাটদের সঙ্গে গড়ে উঠছে তাদের সখ্যতা। এভাবেই রাজধানীতে ঢুকছে ইয়াবার চালান। প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছে, হানিফ, শ্যামলী ও সোহাগ পরিবহনের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকা রুটের চালকরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব পরিবহন কোম্পানির মালিকদের চালক নিয়োগের বিষয় আরও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

দূরপাল্লার পরিবহন সোহাগ স্ক্যানিয়া গাড়ির চালক হওয়ার সুবাদে হরহামেশা আনিছুল হক ওরফে দুলাল এই রুটে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব পেতেন। গাড়ি চালানোর পেশাটি তার দীর্ঘদিনের। তবে রাতারাতি ধনী হবার নেশায় মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মেলান। কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে দিয়েই মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন দুলাল। শনিবার (২০ অক্টোবর) সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর মালিবাগ ডিআইটি রোডের নবাবী খানাপিনা রেঁস্তোরার সামনে থেকে ২০ হাজার পিছ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-২। দুলাল খুলনার খালিশপুর থানার দক্ষিণ কাশিপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ খাঁনের ছেলে।

র‌্যাব সূত্র জানায়, গ্রেফতার দুলাল জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, অভিজাত গাড়ির চালক হিসাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে খুব সহজেই ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করা যায়। এই চালানটি সরবরাহের জন্য তাকে ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। এই লোভেই তিনি চালানটি কক্সবাজার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এর আগেও তিনি বেশ কয়েকটি বড় বড় ইয়াবার চালান ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

র‌্যা-২ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. আনোয়ার উজ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গ্রেফতার দুলাল সোহাগ স্ক্যানিয়া গাড়ির চালক। ২০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট সে তার সঙ্গে থাকা ব্যাগের মধ্যে করে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। পরিবহন থেকে নেমে মাদকের চালানটি সরবরাহ করার সময় তাকে আটক করা হয়।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা সোহাগ পরিবহন মালিকের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তারা এই মাদক পাচারের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। সেজন্য আমার ওই বাসটি জব্দ না করে শুধু চালক দুলালকে গ্রেফতার করি।

শুধু দুলালই নয়, বেশকিছু পরিবহন চালককে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ীরা দেশের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক পাচারের কাজ করছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এক্ষেত্রে শুধু দূরপাল্লার বাস নয়, পণ্যবাহী ট্রাক, দামি প্রাইভেটকারসহ জ্বালানি তেল পরিবহনের ট্রাকও ব্যবহার করছে মাদক ব্যবসায়ীরা।

র‌্যাব সদর দফতর থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, ২০০৪ সালে এলিট ফোর্স র্যা ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে দূরপাল্লার যানবাহন তল্লাশি করে মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ ৪৪ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব যানবাহন থেকে ৪ লাখ ২ হাজার ৬৮০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, এক হাজার ১৯৪ বোতল ফেনসিডিল, ১৯ কেজি গাঁজা ও ২ কেজি হেরোইন উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও মাদক পাচারে সহায়তার দায়ে বিলাশবহুল মোট ২০টি গাড়ি জব্দ করে র‌্যাব।

জব্দ হওয়া তালিকায় রয়েছে- শ্যামলী পরিবহনের ৫টি বাস, হানিফ পরিবহনের ২টি বাস, গ্রীন লাইন পরিবহনের ২টি বাস, তোবা লাইন এলিট পরিবহনের ২টি বাস, সৌদিয়া পরিহনের ২টি বাস, দেশ ট্রাভেলস পরিবহনের ২টি বাস, সালমা এন্টারপ্রাইজের ১টি বাস, শিশির পরিবহনের ১টি বাস, আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের ১টি বাস ও অন্যান্য দুটি পরিবহনের বাস।

এদিকে, দূরপাল্লার যানবাহনে মাদক পাচারকালে ২০১১ সালে একজন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার ও একটি বাস জব্দ করা হয়; ২০১৬ সালে সাত জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার ও তিনটি বাস জব্দ; ২০১৭ সালে ২১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার ও ৯টি দূরপাল্লার বাস জব্দ করা হয়। এদিকে, চলতি বছরের (২০১৮ সাল) আগস্ট পর্যন্ত দূরপাল্লার যানবাহনে অভিযান চালিয়ে ১৫ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার ও সাতটি বিলাসবহুল বাস জব্দ করে র‌্যাব।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ মুফতি মাহমুদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদক পাচার রোধে দূরপাল্লার বিভিন্ন বাসে আমাদের তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে। মাদকের চালান পাওয়া গেলেই পাচারকারী ও ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যাতে দূরপাল্লার এসব পরিবহনে মাদকদ্রব্য বহন করতে না পারে, সে বিষয়ে বাস মালিক, চালক ও হেলপারদের সতর্ক থাকতে হবে। তাদেরও নজরদারি থাকতে হবে।’

র‌্যাব-১০ এর অভিযানে গত ১৯ জুলাই সকালে রাজধানীর ওয়ারী থানা এলাকা থেকে তোবা লাইন (ঢাকা মেট্রো-গ ১৫-৩৩৯৮) বাসে তল্লাশি করে ৪৩ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়।

র‌্যাব ব-৩ এর অভিযানে গত ২৫ জুন সকালে রাজধানীর সায়েদাবাদ জনপদের মোড়ের সামনে থেকে কক্সবাজার থেকে আসা শ্যামলী পরিবহনের (ঢাকা মেট্টো-ব-১৪-৪৮০৭) দুই যাত্রীকে সাত হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়। মাত্র ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে এই চালানটি নিয়ে এসেছিলেন তারা।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. এমরানুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দূরপাল্লার পরিবহনে মাদক পাচার রোধে আমরা কাজ করছি। দূরপাল্লার গাড়িগুলো কোথা থেকে ছাড়া হয় এবং কোথায় গিয়ে থামে, এসব স্থানে পরিবহন সেক্টরের ব্যবস্থাপকরা যাতে নজর রাখে তার জন্য র্যা বের পক্ষ থেকে বেশকিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’

এছাড়াও বাস টার্মিনালগুলোতে কি হয় সেটি নজরদারির জন্য টার্মিনালগুলোকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় রাখার কথা বলেন এ র‌্যাব কর্মকর্তা। দূরপাল্লার পরিবহনে মাদক পাচাররোধে বাস মালিকদের নজরদারি বাড়াতে ও বাস মালিকরা যাতে সচেতন হন সে বিষয়ে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে, এটা আমরাও চাই। কারণ তারা দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। দূরপাল্লার বাসে কেউ যাতে মাদক পরিবহন করতে না পারে সে জন্য আমরাও নজরদারি করছি।’