ডেস্ক নিউজ:
পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এই মজুরি ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা।

বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এ তথ্য জানান। যদিও ন্যূনতম মজুরি ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে করার দাবি ছিল পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নির্ধারিত মজুরির মধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা, খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা।’

পুনর্নির্ধারিত অন্যান্য ধাপগুলোর মজুরির বিষয়ে জানতে চাইলে মুজিবুল হক বলেন, ‘ডিটেইলস কাজের এখনও বাকি আছে। পূর্ণাঙ্গ কাজ করে আমরা গেজেট করব। গ্রেডগুলো আগের মতোই থাকবে।’

চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পোশাক শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। স্থায়ী চার সদস্যের সঙ্গে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ও শ্রমিকদের একজন প্রতিনিধি নিয়ে এই মজুরি বোর্ড গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বোর্ডে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কোনো সিদ্ধান্ত আসছিল না। শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে নির্ধারিত হলো এই মজুরি।

এর আগে ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ওই মজুরি কার্যকর হয় একই বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে। ৫ বছর পরপর মজুরি পুনর্নির্ধারণের নিয়ম রয়েছে।

পোশাক খাতে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে, এদের উপর নির্ভরশীল কয়েক কোটি মানুষ জানিয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন আর নেই, প্রধানমন্ত্রী একটা সেক্টরে ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিন বছরে দু’বার মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছেন। এটা গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো মিটিং করে বাজার বিশ্লেষণ করে সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে তারা অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব যায়, মালিকদের পক্ষ থেকেও একটা প্রস্তাব আসে। অনেক মিটিং হওয়ার পরও তারা ঐকমত্যে আসতে পারেননি।’

‘প্রথমে মালিকদের পক্ষ থেকে মজুরি ৬ হাজার টাকা, এরপর আরও কিছু বাড়াতে বাড়াতে ৭ হাজার টাকায় তারা আটকে যান এবং তারা বলেন, তারা এর বেশি পারবেন না। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ১২ হাজার টাকার প্রস্তাব ছিল, তারা বলেছেন ১২ হাজার টাকার কমে হবে না। এই যখন অবস্থা, আমরা দেখলাম অক্টোবরের পর নির্বাচনকালীন সরকার হবে ও নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা হবে, তখন এই কাজগুলো নীতিগতভাবে এই সরকার করতে পারবে না,’- বলেন প্রতিমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, ‘বেতন পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে যখন অচলাবস্থা তখন প্রধানমন্ত্রী নিজে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের ডেকে আলাপ করেন। আলাপ করে তিনি সিদ্ধান্ত দেন- আমাদের সব পক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গার্মেন্টেসের ক্রেতারা এখন মূল্য কমিয়ে দিয়েছে।’

‘সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ন্যূনতম মজুরি হবে ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ যে শ্রমিকরা আজতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবে তার মজুরি সব মিলিয়ে হবে ৮ হাজার টাকা। গ্রেড অনুযায়ী বেতন আরও বাড়বে। কোনো শ্রমিককে ৮ হাজার টাকার কম মজুরি দেয়ার সুযোগ কোনো মালিকের নেই।’

প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত দুই পক্ষের জন্যই যুগোপযোগী ও যৌক্তিক মন্তব্য করে জাতীয় পার্টির নেতা মুজিবুল হক বলেন, ‘বোর্ডের সদস্যরাও প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পাঁচ বছর শেষ হওয়ার পর থেকেই এই মজুরি কার্যকর হবে। এ জন্য সময়মতো গেজেট প্রকাশ করা হবে।’

গার্মেন্টস শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে। আশা করি কাঙ্ক্ষিত এই মজুরিতে আপনারা সন্তুষ্ট হবেন। আপনারা আপনাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করতে কাজ করে যাবেন।’

ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ন্যূনতম মজুরি বোর্ড আজকে পঞ্চমসভায় বসেছিলাম। আমরা দুই পক্ষের প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম বেশ কয়েকটি মিটিংয়ে। একটা পর্যায়ে আমরা থেমে গিয়েছিলাম, মালিকরা কোনো ক্রমেই ৭ হাজার টাকার বেশি দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চেষ্টা করেছি।’

তিনি বলেন, ‘মালিকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে আরও এক হাজার টাকা বেড়েছে। সেই বিষয়টি আজ বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থাপন করা হয়। আমরাও সবাই সম্মতভাবে মনে করেছি ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা যুক্তিযুক্ত হবে। সেই হিসেবে আমরা আজকে সুপারিশটা তৈরি করেছি।’

বোর্ডে মালিকপক্ষের সদস্য ও বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা ন্যূনতম মজুরি ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হই। শ্রমিক প্রতিনিধিরা ১২ হাজার টাকায়ই থাকে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা ৮ হাজার টাকা দিতে রাজি হই। এটা আগামী ডিসেম্বরের বেতন থেকে কার্যকর হবে।’

পোশাক শ্রমিকদের প্রতিনিধি ও শ্রমিক লীগের মহিলা সম্পাদিকা সামসুন্নাহার ভূঁইয়া বলেন, ‘এই মজুরিটা শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান সবকিছু মিলিয়ে খুব বেশি হয়ে গেছে, আমি তা বলব না। মালিকরা ৬ হাজার ৩ টাকার পর আবার বাড়াতে চাচ্ছিলেন না। আমাদের পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম ১২ হাজার ২০ টাকা। পরে প্রধানমন্ত্রী বিজিএমইএ’র সভাপতিকে মাথায় হাত দিয়ে বাচ্চাদের মতো বলতেছিলেন, ছোট ভাই এটা মেনে নাও। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৮ হাজার টাকা আমরা শ্রমিকরাও মেনে নিয়েছি।’

শ্রমিক প্রতিনিধি ও শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফললুল হক মন্টু বলেন, ‘শ্রমিকরা অনেক দাবি-দাওয়া করেছিলেন, তাদের দাবি ছিল ১২ হাজার, ১৬ হাজার, ১৮ হাজার টাকার। অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী সবকিছু বিশ্লেষণ করে ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দিয়েছেন।’

এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের নিরপেক্ষ সদস্য কামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।