ইমাম খাইর, সিবিএনঃ
নিজ দেশের শাসকগোষ্ঠীর হাতে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশ আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আরেকটি যুদ্ধে আমরা জয় হয়েছি। গত সাড়ে ১১ মাসে একজন রোহিঙ্গাও না খেয়ে মরেনি। চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হয়নি কেউ। সেদিক দিয়ে আমরা আরেকটি যুদ্ধে জয় লাভ করেছি।
মঙ্গলবার (১৪ আগষ্ট) দুপুরে কক্সবাজার কলাতলীর আবাসিক হোটেলের কনফারেন্স কক্ষে রোহিঙ্গাদের নিয়ে উন্মুক্ত ‘আলোকচিত্র প্রদর্শনী’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া একথা বলেন।
রোহিঙ্গা সংকটের নানামুখি বাস্তবতা তুলে ধরতে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত সভায় মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি সরকারের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা তা কঠোরভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার উপর রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। তাতে সরকারের পাশাপাশি ইউএন এজেন্সিগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। মিয়ানমার সরকারকে চাপ দিতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী বলেন, কক্সবাজারের মানুষ গত এক বছরে রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। যেকোন সংকটে আমরা ঘুরে দাড়াতে পারি তার প্রমাণ এই রোহিঙ্গা সংকট। এই সংকটে একটি মানুষও না খেয়ে মারা যায়নি। তবে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে যেতে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পুনর্বাসনের জন্যসবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ্ কামাল বলেন, স্থানীয় জনগণই প্রথম এই সংকটের ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন। এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগের দৃশ্যগুলো ধারণ করায় এর চিত্রগ্রাহক এবং আয়োজক একশনএইড বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। এই আয়োজন ভবিষ্যতে ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের’ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে। এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে সংকটের সামগ্রিকব বিষয়গুলো আনা গেলে বিষয়টি পরিপূর্ণতা পেত, যোগসূত্র লিংকেজ করে দেয়া যেতো। রোহিঙ্গা সংকটের সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া স্থানীয় লোকজনদেরকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান তিনি।
ভবিষ্যতে এই ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এই ধরনের ডকুমেন্টেশন ও প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য রাখবো যেন সবার ভূমিকা আমরা তুলে আনতে পারি। সংকটের সময় স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা সংকটকালীনকাজকে আরও সহজ করে দেয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষের যে উচ্চ ধারণা ছিল বাংলাদেশ তা ধরে রাখতে পেরেছে। রোহিঙ্গারা তাদের অধিকার ও সম্মান নিয়ে তাদের নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবেন আমরা এমনটি আশা করছি। ইতোমধ্যে তাদের নিরাপদ ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে স্থান ও অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য একশনএইড বাংলাদেশ চমৎকার সব কাজ করে যাচ্ছে, বিশেষ করে আজকের এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং চিত্রগ্রাহককে ধন্যবাদ জানান তিনি।
বিশেষ অতিথি ছিলেন ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্মসচিব) মোঃ আবুল কালাম, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল।
অনুষ্ঠানের একশনএইড বাংলাদেশের বোর্ড প্রধান ব্যারিস্টার মঞ্জুর হাসান ওবিই বলেন, “আমাদের দেশে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের এক বছর হচ্ছে। আমাদের এখন এই সংকটের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও নীতি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এই ধরনের ডকুমেন্টেশন খুবই দরকার। একটি জিনিস বিশেষ করে মাথায় রাখতে হবে যে, শরণার্থী যারা এসেছেন তারা যেন পুনরায় ট্রমাটাইজড না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ডকুমেন্টেশন দরকার। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করা দরকার। পাশাপাশি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই সংকটটিকে দেখা, শুধু ভিক্টিমের পারসপেকটিভ থেকে না দেখে মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখা। পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হোস্ট কমিউনিটি ও শরণার্থীদের সম্পর্ক কেমন হবে সে বিষয়ে আলোকপাত করা।’
অনুষ্ঠান সঞ্চালক ছিলেন একশনএইড বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির।
এসময় বাংলাদেশ সরকার, কক্সবাজার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ‘রোহিঙ্গা এক্সোডাস ২০১৭’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
চিত্রগ্রাহক মাহমুদ রহমানের প্রদর্শিত আলোকচিত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিজ দেশে কিভাবে পরবাসী জীবন যাপন করছে এ নিয়ে তাদের কষ্ট, নিপীড়নের চিত্র করুণভাবে ফুটে উঠে। চিত্রিত হয় তাদের দেশান্তরিত হওয়ার মূল রহস্য।
বক্তারা মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন।
তারা বলেছেন, এক বছরে সংকট মোকাবেলায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার বিষয়ে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে রেহিঙ্গাদেরকে তাদের মাটিতে ফিরিয়ে নিতে সবপক্ষকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করাটা জরুরি। সংকটের সুষ্ঠু সমাধানে ডকুমেন্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এজন্য ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়াতেও গুরুত্ব দেয়া উচিত।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দশ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, যাদের বেশীরভাগই নারী এবং শিশু। দেশহীন এই জাতিটিকে সারাবিশ্বের সবচেয়ে বিপদাপন্ন জাতির মধ্যে একটি, যারা ন্যূনতম মানবিক অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নাগরিক হিসেবে মিয়ানমার কর্তৃক স্বীকৃতি পায়নি, যেখানে তারা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ এবং সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এরই ফলে সর্বপ্রথম ৭০ এর দশক, এরপরে ৯০ এর দশক এবং সর্বশেষ গত তিনবছরে তারা বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। ২০১৭ এর অগাস্টের পূর্বে তিন লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজাওে এসে বসবাস করছেন। রাখাইন রাজ্যে নতুনভাবে সহিংসতা এবং নির্যাতন শুরুর পওে গেল বছরের ২৫ অগাস্টের পর আবার সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসেন। এত অল্প সময় বিশাল সংখ্যক মানুষের দেশছাড়া হওয়ার ঘটনাটাটি বিশ্বেও সবচেয়ে দ্রুত বর্র্ধিত শরণার্থীর আশ্রয়স্থল হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে সারাবিশ্বে পরিচিত।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, একশনএইড বাংলাদেশে দেশ ও দেশের বাইরে রোহিঙ্গা সংঙ্কট সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। এই বিষয়ের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে এ বছরের গোড়ার দিকে ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা বলেছি, রোহিঙ্গাদের উপর চালানো নিপীড়নকে গণহত্যা, গণসহিংসতা, মানবতা বিরোধী অপরাধ এবং জাতিগত নিধনের ঘটনা। খুব দ্রুত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক, সর্বজন স্বীকৃত এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা উচিৎ। একই সঙ্গে যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের বিচারের আওতায় এনে রোহিঙ্গাদের পর্যাপ্ত মানবিক এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান করা উচিৎ এবং এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই একশনএইড বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে।’
আগস্টের ঘটনার পরপর বাংলাদেশ সরকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এই সংকট উত্তেরণে মানবিক সহায়তায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। হাজার হাজার একর জমি রোহিঙ্গাদেও বসবাসের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। আশ্রয় শিবির নির্মাণ, খাদ্য, পুষ্টি, পানি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং, প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি সেবাসমূহ দেয়া হচ্ছে প্রথম থেকেই। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী যোগানের ব্যবধান ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক দৃশ্যমান তথ্যপ্রমানাদি/ প্রামাণ্য চিত্র এবং গল্পগুলি এখন পর্যন্ত একশনএইড বাংলাদেশের এডভোকেসি কৌশলগুলির অন্যতম দলিল হিসেবে কাজ করছে। দৃশ্যমান এই দলিল সংগ্রহ করতে একশনএইড আলোকচিত্রকর মাহমুদুর রহমানের সাথে কাজ শুরু করে। এর ফলে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ এবং এই নাগরিক সমাজের সদস্যের দৃষ্টিকোন থেকে রোহিঙ্গাজনগোষ্ঠির গল্পগুলো কেমন হতে পারে এবং এই সংকটটির একটি সামগ্রিক প্রতিরূপ দেখতে পাওয়া যায়। আলোকচিত্রকর মাহমুদুর রহমানের সৃস্টিশীলতায় কোন প্রকার হস্তক্ষেপ না করে সহায়ক শক্তি হিসেবে পাশে থাকে একশনএইড। বেঁচে থাকার আকুতি, জীবনসংগ্রাম, মানবিক শক্তির স্পষ্ট অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তার তোলা ছবিগুলোতে। হৃদয়স্পর্শী ছবিগুলো শুধু অসহনীয় কষ্ট, মানসিক আঘাত এবং অসহায়তাকে তুলে ধরেনা, বরং মর্মভেদী গল্পগুলো বন্ধন এবং ভাতৃত্বকেও প্রকাশ করে। ময়নাঘোনায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের জন্য সাইট ম্যানেজমেন্ট-এর কাজ করছে একশনএইড বাংলাদেশ। এছাড়া প্রথম থেকেই জরুরি খাদ্য, পানি, পয়নিষ্কান, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং, নারীদের নিরাপত্তার বিষয়সহ জরুরি সহয়তা নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে আছে একশনএইড বাংলাদেশ। যেহেতু মায়ানমার থেকে আসা মানুষের মধ্যে অধিকাংশ নারী তাই এই জনগোষ্ঠির মানসিক, শারীরিক নিরাপত্তার জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করছি আমরা। রোহিঙ্গাদের একটি সম্মানজনক জীবন নিশ্চিতের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া ট্রেনিং-এর মাধ্যমে জীবন জীবিকা নিশ্চিতের জন্য কাজ করছি আমরা। কমিউনিটি ভিত্তিক কৃষির প্রচলন করার চেষ্টা চলছে। যুবক, বৃদ্ধ, শিশুদের মৌলিক বিষয়গুলোর নিরাপত্তার জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক কাজ করছে একশনএইড বাংলাদেশ।