ইমাম খাইর, সিবিএন
কক্সবাজার সিএসও-এনজিও ফোরাম এবং কোস্ট ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় অধিবাসীদের উপর বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের আগমনের প্রভাব এবং বর্ষা মৌসুমে সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে পাবলিক ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শনিবার (৩১ মার্চ) কক্সবাজার কলাতলীর আবাসিক হোটেলের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত গণসংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব কে.এম আব্দুস সালাম।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে স্থানীয় মানুষ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। এটা ধরে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখতে হবে। কারণ, বিশ্বের নজর এখন অংসান সুচি থেকে শেখ হাসিনার দিকে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার ইউএন-এর পক্ষে মায়নমার বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের জন্য কাজ করছি। এতে বিশ্বে আমাদের সুনাম বেড়েছে।
দেশী-বিদেশী এনজিও-দের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এনজিওগুলোর কাজে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। এনজিওরা যে ভাল কাজ করছে তা জনগণকে জানাতে ও দেখাতে হবে। এনজিওদেরকে স্থানীয় জনগণের সাথে মিলে মিশে কাজ করতে হবে।
মহাপরিচালক বলেন, এনজিওদের কাজ এখন আর ১৯৮০/১৯৯০ সালের মতো করলে হবে না। এখন ডিজিটাল যুগ। আগের মতো কাজ করলে চলবে না। জনগণ মানবে না।
তিনি বলেন, মায়ানমার নাগরিকদের ব্যাপারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য্য ধরেছেন। আমাদেরকেও ধৈর্য্য ধরতে হবে। তাতে আমরা অবশ্যই সফল হবো।
সভার প্রধান বক্তা শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার ও অতিরিক্তি সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আইওএম, ই্উএনএইচসিআর, আইএসসিজি মিলেমিশে একত্রে কাজ করছে। সম্পদের ও অর্থের ব্যবস্থা করছে যাতে মায়ানমার বাস্তুচ্যুত নাগরিকসহ কক্সবাজারের স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের যথাযথ সহায়তা করা যায়। সভায় তিনি শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার অফিস কিভাবে কাজ করছে তার বিবরণ দেন।
মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, আমরা প্রতিদিন ৪ টি ফুটবল মাঠের সমান বন হারাচ্ছি। অন্য ক্ষেত্রেও ক্ষতি কম নয়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি)-এর রেসপন্স পাবো। যার মধ্যে ২৫% বরাদ্দ স্থানীয় কমিউনিটির জন্য সহায়তার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মায়ানমার নাগরিকদের দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, মায়নমার নাগরিকদের বঞ্চনা ও বিরোধ সমাধান করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব।
সভায় তিনি মায়ানমার নাগরিকসহ স্থানীয় নাগরিকদের জন্য গৃহীত উদ্যোগসমূহ বিস্তারিত তুলে ধরেন।
গণসংলাপে প্যানেল মেম্বার হিসেবে বক্তৃতা করেন- দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত, বিসিএএস এর নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দুর্যোগ ফেরামের অধ্যাপক নাইম গওহর ওয়ারা, আইএসসিজি-র সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর সম্বুল রিজভি, ইউএনএইচসিআর-এর কর্মকর্তা এলিজাবেথ প্লেস্টার এবং আইওএম-এর কর্মকর্তা ম্যানুয়েল মনিজ পেরিইরা।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপআ) কক্সবাজার জেলা সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী।
গণসংলাপ সভার মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কোস্টট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক ও সিএসও-এনজি ফোরাম কক্সবাজারের কো-চেয়ার রেজাউল করিম চৌধুরী এবং পাল্স এর ও কক্সবাজার সিএসও-এনজি ফোরামের (সিসিএনএফ) কো-চেয়ার আবু মোরশেদ চৌধুরী।
সভায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কক্সবাজার সিএসও-এনজি ফোরামের কো-চেয়ার ইপসার নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান।
পাবলিক ডায়ালগে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন দাবী দাওয়া তুলে ধরেন- উখিয়া পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী, টেকনাফ হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী, বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মৌলানা আজিজ উদ্দিন, হ্নীলার ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আবুল হোসেন।
বক্তারা এনজিও ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন- রোহিঙ্গাদের কাছে অনেক অস্ত্র আছে। অস্ত্রসহ তারা দেশে ঢুকেছে। এসব অস্ত্র বাংলাদেশী মানুষের উপর ব্যবহার করার আশংকা রয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। অন্যথায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার কাছে স্থানীয় জনগণ সংখ্যালঘুর আচরণের শিকার হতে পারে।
স্থানীয়রা দুঃখের সঙ্গে তুলে ধরে জানান- অনেক রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশীর চেয়ে বেশী বেতনে ক্যাম্পগুলোতে চাকুরী করছে। অর্থ স্থানীয়দের চাকুরীদের অবমূল্যায়ন করছে চিহ্নিত কয়েকটি এনজিও। রোহিঙ্গাদের চাকুরীর বিধান আছে কিনা? জানতে চান স্থানীয় ক্ষুব্ধ লোকজন।
পাবলিক ডায়ালগ সভায় উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের (রাজাপালং, পালংখালী, হোয়াক্যং, হ্নীলা ও বাহারছড়া) অর্ধশতাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ইউএন এজেন্সি, স্থানীয়, জাতীয়-আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থার কর্মকর্তাগণ এবং সুশীলসমাজ, প্রিন্ট ও ইলেক্টনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিগণও সভায় উপস্থিত ছিলেন।
রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত অথবা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবী তুলে বক্তব্য দেন উখিয়া বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক ও রোহিঙ্গা প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ সিকদার।
রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় দুর্বিসহ অবস্থা তুলে ধরে বক্তৃতা করেন- রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ শাহজাহান, খুরশিদা বেগম, পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরুল আবছার চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ, নুরুল আমিন, হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জালাল আহমদ, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হোসাইন আহমেদ, আবুল হোছেন, এবং মর্জিনা আক্তার সিদ্দিকী, বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোঃ সোনা আলী প্রমুখ।
সভার শুরুতে কোস্ট ট্রাস্ট পরিচালিত, মায়ানমার বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠির আগমনের ফলে কক্সবাজারের স্থানীয় জনসাধারণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কৃষি ও সর্বোপরি পরিবেশের কি ক্ষতি হয়েছে? তার গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন কোস্ট ট্রাস্ট-এর সহকারী পরিচালক বরকত উল্লাহ মারুফ।
মায়ানমার জনগোষ্ঠির আগমনের ফলে উখিয়া-টেকনাফের তথা কক্সবাজার জেলার প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, যা পূরণ করতে এখনই উদ্যোগ না নিলে দীর্ঘদিন এই ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে বলে তিনি উপস্থাপনায় জানান।