আবদুল আজিজ, (বাংলা ট্রিবিউন) কক্সবাজার:

মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা, বর্বরতা, অমানবিকতা দেখেছে রোহিঙ্গা শিশুরা। দেখেছে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াসহ আপনজনদের ওপর নির্যাতন, ধরে নিয়ে যাওয়া ও  তাদের হত্যার দৃশ্য। রোহিঙ্গা শিশুদের অনেকেই বাবা-মাসহ হারিয়েছে পরিবারের একাধিক সদস্য। হারিয়েছে সর্বস্ব। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এই শিশুরা এখনও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এসব শিশুদের মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে গড়ে তোলা হয়েছে ১শ’ ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী শিশুবান্ধব কেন্দ্র। এই শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলো এখন পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা শিশুদের একটু স্বস্তির জায়গায়। সেখানে রোহিঙ্গা শিশুরা আঁকছে নানা রঙের ফুল, মনের আনন্দে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছে, প্রাণ খুলে হাসছে।  মিয়ানমারে সহিংসতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। কোনও না কোনোভাবে এসব শিশুদের সবাই ভয়াবহতার শিকার। এই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। সে লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গড়ে তোলা হয়েছে ১শ’ শিশুবান্ধব কেন্দ্র। আর এই শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলোতে আনন্দে সময় কাটছে রোহিঙ্গা শিশুদের। বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ এর এই উদ্যোগে খুশি রোহিঙ্গা অভিভাবকরাও।

উখিয়ার বালুখালীর জুমেরছড়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফেরুজা বেগম বলেন, ‘রাখাইনে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ ও অমানবিক নির্যাতন দেখেছে আমাদের সন্তানেরা। সব সময় মানসিক চাপে দিন পার করতে হয়েছে। এই দুঃসময়ে আশ্রয়শিবিরে শিশুদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের এই উদ্যোগে আমরা মহাখুশি।’ উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মৌলভী জাফর আলম। তার বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিদং গ্রামে। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানদের সামনেই তাদের মায়ের ওপর নির্যাতন চালায় সে দেশের সেনাবাহিনী। এই দৃশ্য আমাকে বারবার যেমন তাড়া করছে একইভাবে আমার সন্তানদেরও বিপর্যস্ত করেছে। কিন্তু সম্প্রতি আমার ছোট সন্তানকে শিশুবান্ধব কেন্দ্রে নেওয়ার পর থেকে তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন দেখা গেছে। সে চাপ কাটিয়ে উঠছে।’

উখিয়ার মধুরছড়া ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘মিয়ানমারে এ রকম শিশুবান্ধব কেন্দ্র তো দূরের কথা, স্বাভাবিক খেলারও সুযোগ পায় না বাচ্চারা। এখন তো সবসময়ই সেনাবাহিনী ও মগদের ভয় তাড়া করে বেড়ায় তাদের। কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য এই ব্যবস্থা সত্যিই স্বপ্নের মতো।’

ফেরুজা, জাফর, আব্দুস সাত্তারের মতো উখিয়া ও টেকনাফের আরও অনেক অভিভাবক শিশুবান্ধব কেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে ইউনিসেফ এর কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট ফারিয়া সেলিম বলেন, ‘শিশুবান্ধব কেন্দ্রে অন্য শিশুদের মাঝে এসে অসহায় রোহিঙ্গা শিশুরা আবারও হাসছে, দুঃসহ স্মৃতি ভুলে তারা প্রাণ খুলে গান গাইছে। আমাদের কর্মীবাহিনী এসব শিশুদের সঙ্গে খেলে, ছবি আঁকে, সারাদিন সময় কাটায়। আমরা চাই তারা মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞ ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক।’

. রোহিঙ্গা এতিম শিশুদের সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও জেলা ভারপ্রাপ্ত সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. ইমরান খান বলেন, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুস্বাক্ষরকারী একটি দেশ। রোহিঙ্গা শিশুসহ সব শিশুর ভাষা, সংস্কৃতি চর্চার অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত যে কোনও বয়সের শিশু যে কোনও সময় আসতে পারে এসব কেন্দ্রে।’

উল্লেখ্য, মিয়ানমারে সহিংসতার পর থেকে প্রাণভয়ে আশ্রয়ের জন্য রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। গত ২৪ আগস্ট রাতে হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু আশ্রয় নিয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয় শিবিরে। এদের মধ্যে ৬০ শতাংশ শিশু রয়েছে। এসব শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে বিনোদন ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।