ডেস্ক নিউজ:
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের বসতি হিসেবে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ঠেঙ্গারচরকে। এরই মধ্যে সেখানে ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু করেছে নৌবাহিনী। পরবর্তী পর্যায়ে শুরু হবে সড়ক, বাড়ি, মসজিদ, হাসপাতাল, স্কুলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির কাজ। এসব কাজ শেষ করে আগামী এক বছরের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরুর পরিকল্পনা নিয়ে সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সরকারি বাহিনী ও স্থানীয় মগদের নির্যাতনের শিকার হয়ে দলে দলে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। কেবল গত ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর আগেও সহিংসতার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা একাধিকবার পালিয়ে এসেছেন এসেছেন বাংলাদেশে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সাত লাখেরও বেশি। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া ছাড়াও বান্দরবানের সীমান্ত এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রোহিঙ্গারা। ঠেঙ্গারচরে আট থেকে ১০ লাখ মানুষের পুনর্বাসন সম্ভব বলেই রোহিঙ্গাদের একত্রিত করে একটি জায়গায় রাখার পরিকল্পনা থেকেই এই চরকে বেছে নিয়েছে সরকার।

ঠেঙ্গারচরকে বসতি হিসেবে গড়ে তোলার কাজে নৌবাহিনীর সহায়তার সার্বিক সমন্বয় করছে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষে সরকার ঠেঙ্গারচরে সড়ক, বাড়ি, মসজিদ, হাসপাতাল, স্কুলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করবে। এরপরই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সেখানে পুনর্বাসন করা হবে। এরই মধ্যে এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদীন ঠেঙ্গারচর পরিদর্শন করেছেন। এর পর থেকেই এই এলাকায় চলছে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম।

জানা গেছে, নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপ থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার ও চট্টগ্রামের সন্দীপের প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় সাগরের মধ্যে অবস্থান ঠেঙ্গারচরের। এর আয়তন কমবেশি ১৫ বর্গমাইল বা ১০ হাজার একর। ২০১০-১১ সালে এই চরে সরকার বনায়ন শুরু করার পর ২০১৩ সালে গেজেটের মাধ্যমে ঠেঙ্গারচরকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানকার চার হাজার আটশ একরের এই বনে লাগানো কেওড়া গাছগুলো উচ্চতায় চার থেকে আট ফুট হয়ে উঠেছে। এখানেই রোহিঙ্গাদের জন্য আবাস গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার।

হাতিয়া বা সন্দীপ থেকে এই ঠেঙ্গারচরে যাতায়াত এখনও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর। জোয়ারের সময় এর নিচু এলাকাগুলো ডুবে যায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসও নিয়মিত। বনবিভাগ বলছে, জোয়ারের পানি থেকে মানুষ ও বসতবাড়ি বাঁচাতে নির্মাণ করতে হবে বেড়িবাঁধ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষার জন্য তৈরি করতে হবে আশ্রয়কেন্দ্র। এছাড়া সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও করতে হবে। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলেই ঠেঙ্গারচর বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে বলে অভিমত বনবিভাগের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঠেঙ্গারচরে বর্তমানে কোনও বসতি নেই। হাতিয়া, সন্দীপ ও ঢালচরের মৎস্যজীবীরা ঠেঙ্গারচরের আশপাশে মাছ শিকার করেন এবং মাঝে মাঝে এই চরে এসে বিশ্রাম নেন। চরটিতে তৃণভূমিতে আশপাশের এলাকার গৃহপালিত পশুরা বিচরণ করে। তবে এখনও জোয়ারের পানিতে এর অনেক স্থান ডুবে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় প্রবল জোয়ার ও বড় বড় ঢেউ তৈরি হলে গোটা চরই প্লাবিত হয়ে পড়ে। তাই বসতি গড়ে তোলার আগেই চরের চারপাশে উঁচু বেড়িবাঁধ দেওয়ার কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বসতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ঠেঙ্গারচর। সেখানে ভূমি উন্নয়ন ও যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণের কাজ করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ঠেঙ্গারচর পুরোপুরি প্রস্তুত হলে সেখানে একসঙ্গে আট থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হবে। সরকার সে লক্ষ্যেই কাজ করছে।’

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলে, ‘রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই মিয়ানমার নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরত নেবে। তবে এর আগ পর্যন্ত মানবিক কারণেই বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে সরকারের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে ত্রাণমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাই তাদের এক জায়গায় রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ঠেঙ্গারচরকে। জায়গাটিকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে সব ধরনের উন্নয়ন কাজ চলছে। সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যেই এসব কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি। এর পরই রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে।’ বাংলাদেশে নৌবাহিনীর শত শত সদস্য ঠেঙ্গারচরকে বসবাসের উপযোগী করতে দিনরাত কাজ করছে বলে জানান মায়া।