হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর:
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর ঐতিহাসিক হিজরতের উজ্জল স্মারক পবিত্র হিজরী সন। জীবনধারায় সন-তারিখের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি থেকে ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (র.) তাঁর শাসনামলে হিজরী সনের প্রবর্তন করেন। মুহাররমসহ ১২টি মাস নিয়ে হিজরী সন। ১২ মাস নিয়ে বর্ষ গণনার এই সূত্র পবিত্র কুরআন মজীদ থেকেই পাওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমান সমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে’। (সূরা- তওবা, আয়াত- ৩৬)।

হিজরী সনের সূচনা
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (র.) তার শাসনকালে লক্ষ্য করলেন, সরকারি নথিপত্রে মাস লেখার নিয়ম থাকলেও বর্ষ লেখার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ও জনসাধারণের জীবনধারায় ব্যাপক বিড়ম্বনা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছিল। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু মূসা আশআরী (র.) ও হযরত ওমর ফারুক (র.) এর দৃষ্টি আকর্ষন করেন। ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত ওসমান (র.) ও হযরত আলী (র.) প্রমূখ শীর্ষ সাহাবায়ে কেরাম (র.) এর সাথে পরামর্শক্রমে মহানবী (স.) এর ঐতিহাসিক হিজরতের স্মৃতিকে ধারণ করে ৬৩৯ ঈসায়ী সনে হিজরী সন নামের স্বতন্ত্র এই সনের ধারা প্রবর্তন করেন। হযরত ওমর ফারুক (র.) এর অসংখ্য অমর কীর্তির মধ্যে হিজরী সনও অন্যতম।

মু’মিনদের আত্মা ও আমলের সাথে হিজরী সনের সম্পর্ক
সমগ্র বিশ্বের সকল মুমিন মুসলমানদের অন্তর জুড়ে রয়েছে হিজরী সনের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। মুসলিম উম্মাহর নিকট এই সন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগী, আমল, অনুশাসনের সাথে হিজরী সনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমন- নামাযের নির্ধারিত সময়, রোযা, হজ্ব, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, আশুরা, আইয়্যামে বীজ প্রভৃতি ইবাদত ও আমলের উপলক্ষ্যের সাথে হিজরী বর্ষ তথা চাঁদের তারিখের সম্পৃক্ততা অবিচ্ছেদ্য ও অনস্বীকার্য। সর্বোপরী মুসলিম জীবনে হিজরী সনের প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এজন্য হিজরী বর্ষের হিসাব রক্ষা করাও মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।

হিজরী সনের হিসাব রাখা ফরযে কেফায়া
শরীয়তের বিধানাবলীর সময় নিরূপনের ভিত্তি যেহেতু চাঁদের তারিখ সেহেতু এই তারিখ তথা হিজরী বর্ষের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরযে কেফায়া। হাকীমুল উম্মাত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) সহ প্রখ্যাত মুফতিয়ানে কেরাম এই মর্মে ফতোয়া প্রদান করেছেন। হিজরী বর্ষের হিসাব রাখার সহজ পদ্ধতি হলো প্রাত্যহিক কাজ কর্মের রেকর্ড সংরক্ষণ ও লেখালেখিতে চাঁদের তারিখ ব্যবহার করা।

বাংলাদেশে হিজরী সন ও আমাদের দাবী
বাংলাদেশে প্রচলিত সর্বাধিক প্রাচীন সন হল হিজরী সন। প্রবর্তনের এক বছর পর তথা ৬৪০ ঈসায়ী থেকে হিজরী সন আমাদের দেশে প্রচলিত হয়ে আসছে। এদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারের সাথে সাথে হিজরী সনেরও ক্রমবিকাশ ঘটে। ফলশ্রতিতে ঐতিহাসিক হিজরী সন এদেশের রাষ্ট্রীয় সন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এখনও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবনকর্মে হিজরী সনের প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই অন্যান্য সনের পাশাপাশি হিজরী সনকেও দাফতরিক সন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রাণের দাবী।

কেমন হওয়া প্রয়োজন আমাদের অনুভূতি
আমরা কি গভীরভাবে হিসাব করেছি? আমাদের জীবন থেকে যে দেখতে দেখতে আরও একটি বছর বিয়োগ হয়ে গেল! ১৪৩৮ হিজরী বিদায় নিয়ে সূচিত হলো ১৪৩৯ হিজরী নববর্ষ। এভাবে বছরের বিদায়-আগমন আল্লাহ পাকের কুদরতী ব্যবস্থাপনার অংশ। দিনে সূর্যের কিরণ, রাতে চাঁদের আলো, রাতের শেষে দিন, দিনের শেষে রাত এভাবে সপ্তাহ, মাস, বছর করে ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর হায়াতের ক্রমশঃ সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া মহান আল্লাহর চিরন্তন নিয়মেরই ধারাবাহিকতা। মানুষ যাতে সময়ের হিসাব রেখে সন্তর্পনে জীবন যাপন করতে পারে, ক্ষণস্থায়ী এই হায়াতের শেষে একদিন যে অবশ্যয়ই আল্লাহর দরবারে ফিরে যেতে হবে তা যাতে কেউ ভুলে না যায় সে জন্য আল্লাহপাক দিন রাতের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যদিয়ে বর্ষের গমনাগমনের এই নেজাম কায়েম করেছেন। এতে চিন্তাশীল মানুষদের জন্য রয়েছে আল্লাহ তা’আলার মহান নিদর্শন। এ বিষয়ে কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি বানিয়েছেন সূর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনজিল সমূহ, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব, আল্লাহ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি। কিন্তু যথার্থতার সাথে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষন সমূহ সে সমস্ত লোকের জন্য যাদের জ্ঞান আছে। নিশ্চয় রাত-দিনের পরিবর্তনের মাঝে এবং যা কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও যমীনে সবই হল নিদর্শন সে সব লোকের জন্য যারা ভয় করে’। (সূরা- ইউনুছ, আয়াত- ৫ ও ৬)। অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্যে’। (সূরা- আলে ইমরান, আয়াত- ১৯০)।

কুরআনে কারীমের উপরোক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা প্রতিভাত হয়, দিন রাতের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যদিয়ে বছরের বিদায়-আগমনে বোধসম্পন্ন, জ্ঞানী ও তাক্ওয়াবান লোকেরা অবশ্যয়ই চিন্তা করবেন। তারা জীবনের হিসাব করে আপন বিবেকবোধ থেকে বলবেন, দেখতে দেখতে জীবন থেকে আরও একটি বছর বিদায় নিয়ে গেল, হায়াত ক্রমশঃ ফুরিয়ে যাচ্ছে। অথচ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কি আমল করতে পারলাম। নিজেকে আল্লাহ তা’আলার খালিস বান্দাহ্ হিসেবে কতটুকু গড়তে পেরেছি। মহানবী (স.) এর প্রকৃত উম্মত হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করতে পেরেছি কি না? হায়াত শেষ হয়ে গেলেতো আর আমল করার অবকাশ নেই। এমন অনুভূতিই মুমিনদের অন্তরে জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন।

নববর্ষ বরণ অপসংস্কৃতির চর্চা নয়, চাই আত্মসমালোচনা
এক একটি বছরের বিদায় মানেতো হায়াতের গন্ডি ছোট হয়ে আসা, মৃত্যুর পথে অগ্রসর হওয়া! তাই নববর্ষ বরণের নামে কোন প্রকৃত মুসলমান বা নীতিবান মানুষ অনৈতিক উল্লাসের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিতে পারে না। মেতে উঠতে পারেনা অপসংস্কৃতিতে। বরং বিদায়ী বছরের যে সময়টুকু আল্লাহ তা’আলার মর্জি মোতাবেক অতিবাহিত করার তাওফিক হয়েছে তার জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন, আর যা আল্লাহর নাফরমানিতে কেটেছে তার জন্য অনুশোচনা, সেই সাথে মহান আল্লাহর নিকট আগামীতে সৎ জীবন যাপনের তাওফিক এবং আগত বছরের জন্য শান্তি ও রহমত কামনা করাই বর্ষের গমনাগমনে আমাদের জন্য ইসলামের মহান শিক্ষা।

কারণ জীবনের প্রতিটি মূহুর্তের হিসাব রাখা এবং আল্লাহভীতি তথা পরকালীন জবাবদিহির মানসিকতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করা মু’মিনদের জন্য কর্তব্য। মানবতার মুক্তির অগ্রদুত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ইরশাদ করেন ‘পাঁচটি অবস্থাকে পাঁচটি অবস্থার পূর্বে গণীমত মনে কর, তোমার যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, তোমার সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, তোমার ধণাঢ্যতাকে দারিদ্রের পূর্বে, তোমার অবকাশকে ব্যস্ততার পূর্বে, তোমার জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে’। এই হাদীসে যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে এবং জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে মূল্যায়নের তাগিদ দিয়ে রাসুল (স.) মূলতঃ হায়াতকে দায়সারা ভাবে না কাটিয়ে প্রতিটি মূহুর্ত পরকালীন জবাবদিহির অনুভূতি নিয়ে অতিবাহিত করার শিক্ষাই দিয়েছেন। এই শিক্ষার অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার জন্য একটি বর্ষের বিদায় এবং নতুন বর্ষের আগমনের এ সন্ধিক্ষণ খুবই গুরুত্ব বহন করে। গত বছরের পর্যালোচনা ও নতুন সঙ্কল্পে উজ্জ্বীবিত হওয়ার এটি যথার্থ সময়।

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের হিসাবের সময় খুবই নিকটে। অথচ তারা গাফিল হয়ে বিমূখ হয়ে রয়েছে’। (সূরা- আম্বিয়া, আয়াত-১)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (র.) বলেন, ‘হিসাব করার পূর্বে নিজের হিসাব করে নাও, তোমার আমল পরিমাপ করার পূর্বে নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও। তোমার জীবনের আমলকে সজ্জিত করে নাও, কিয়ামত দিবসের সেই বিশাল ময়দানে উপস্থিতির প্রস্তুতি নাও, যেদিন কারো আমল নামা স্পষ্ট থাকবেনা। (তিরমীযী)। বিশ্ববিখ্যাত আধ্যাত্মিক মনীষী হযরত জুনাঈদ বাগদাদী (রহ.) কে প্রশ্ন করা হলো, আপনি আল্লাহর ওলির মর্যাদা কিভাবে পেলেন? জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ ত্রিশ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে আমলের হিসাব করেছি। (তাফসিরে কুরতুবী)। এভাবে মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ্র মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনা।

হিজরী সন ঈমানী চেতনার অনন্ত উৎস
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) তাওহীদ ও রেসালাতের পতাকা তলে মানব জাতিকে আহ্বান করার কারণে মক্কার কাফেরদের দ্বারা যখন চরম নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছিলেন এমনি ক্রান্তিকালে মহান রাব্বুল আলামীন তার প্রিয় হাবিবকে হুকুম করলেন, মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার জন্য। যে মক্কার সাথে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর আত্মা ও নাড়ির সম্পর্ক সে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি ৬২২ ঈসায়ী সনে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। এসময় তিনি মদিনার দিকে রওয়ানা হয়ে কাবার দিকে তাকিয়ে বারবার বলছিলেন, তোমাকে বড় ভালবাসি, তোমাকে বড় ভালবাসি। কিন্তু তোমার প্রতিবেশিরা আমাকে তোমার কাছে থাকতে দিল না। এভাবে মহান প্রভূর নির্দেশ পালনে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করার অপূর্ব ও অকৃত্রিম আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করেই হিজরী সনের সূচনা। মূলত বছরান্তে মুহররমের এক ফালি বাঁকা চাঁদা মু’মিনের দ্বারে হাজির হয় হিজরতের সেই ত্যাগী আহ্বান নিয়ে। এভাবে যুগ-যুগান্তরে মুমিনের অন্তরে হিজরী সন সঞ্চার করবে অনন্ত ঈমানী চেতনা।

আসুন, হিজরী নববর্ষের শুভাগমনের এই মহতি সন্ধিক্ষণে অতীতের গোনাহ সমূহের তওবা করে নিই এবং ভবিষ্যতে মহান আল্লাহর হুকুম ও রাসুল (স.) এর তরীকা মোতাবেক আদর্শিক জীবনধারার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করি।

লেখক
খতিব,
শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ
পৌরসভা, কক্সবাজার।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ
ইমেইল: hafezabulmanzur@gmail.com
তারিখ ২১/০৯/২০১৭ ইংরেজী