জাকারিয়া আলফাজ, টেকনাফ :
মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর সেদেশের সরকারি বাহিনীর সীমাহীন নির্যাতনের জন্য তথাকথিত রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)’র কর্মকান্ডকে দায়ী করছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। আরসা রোহিঙ্গাদের কাছে হারাকাহ্ আল ইয়াকিন নামে বেশি পরিচিত। আরসা বা আল ইয়াকিন যাইহোক এ সংগঠনের কর্মকান্ডের প্রতি যথেষ্ট সন্দিহান রয়েছে রোহিঙ্গাদের। সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের মধ্যে এমন আস্থাহীন হয়ে পড়েছে যে, রোহিঙ্গারা তাদের করুন পরিণতির জন্য মুলত আল ইয়াকিন (আরসা) কে দায়ী করছেন।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, গত ২৪ আগস্ট সেদেশের ৩৬টি সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে আল ইয়াকিন (আরসা)’র হামলার পূর্ব পর্যন্ত তারা অনেকটা নিরাপদে ছিলেন। আরসা’র ঘটনার পরপরই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা মিলে মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। একের পর এক মুসলমানদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষন ও শিশুদের হত্যার মতো জঘন্যতম বর্বরতায় মেতে ওঠেন। তাদের বর্বরতায় প্রাণ ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পালিয়ে এসছেন অন্তত ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ( সাধরণের ধারণা)। রোহিঙ্গাদের এমন দুরাবস্থার নেপথ্য কি ? কি ভাবছেন রোহিঙ্গারা ? রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বেশ কিছু উত্তর।
রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, “আল ইয়াকিন (আরসা) তাদের আশ্বস্থ করেছিল এই বলে যে, তারা আরাকানের রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বন্ধ ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে আল ইয়াকিন (আরসা) নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কোন কর্মসূচি না দিয়ে শুরুতেই চরমপন্থার পথ বেছে নেন, যাতে কিনা সাধারণ রোহিঙ্গাদের সমর্থন ছিলনা। রোহিঙ্গারা বরাবরই বুঝতেন যে, রাতারাতি গুটি কয়েক আল ইয়াকিন (আরসা) সদস্যদের চাপাচাপিতে আরকান রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বতো দূরেই, ঠিকে থাকাও দূরহ হয়ে পড়বে। ঠিক তেমনটি ঘটেছে আরাকানে।
মংডুর গর্জনদিয়া এলাকা থেকে আসা সালিম (নাম পরিবর্তিত) পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। ওপারে তারা এতোদিন সেদেশের সরকারি বাহিনীর সাথে কোন ঝামেলা ছাড়াই কোনমতে নিরাপদে ছিলেন। কিন্তুআল ইয়াকিন (আরসা) ২৪ আগস্টের ঘটনার পর থেকে মোটামুটি শান্ত আরাকান রোহিঙ্গাদের জন্য বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত হবে এমন আশায় ওপারেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্বরতা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে সলিম উল্লাহরা আর ঠিকতে পারেনি।
সালিম গত ১৫ সেপ্টেম্বর পাড়ি জমিয়েছেন বাংলাদেশে। নাফনদ পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ ঘোলার চরে নামলে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, আমি আল ইয়াকিন বা আরসা’র দ্বারা সংঘঠিত কাজটি মোটেও সমর্থন করিনা। পবিত্র কুরবানির ঈদের আগে কি দরকার ছিলো পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ? তারা কি রাতারাতি আরাকান আজাদ করতে চেয়েছিলেন ? আর তা যদি হয়, তাহলে মিয়ানমার স্বশস্ত্র বাহিনী যখন আমাদের মতো সাধারণ লোকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে অত্যাচার শুরু করে দিয়েছে, হত্যা, ধর্ষণ ও বাড়ি বাড়ি আগুন দেয়ার মতো কাজ করছিল তখন আরসা বলুন আর আল ইয়াকিন বলুন তারা কোথায় ছিলেন ?
মিয়ানমার রাচিডং থেকে আসা যুবক রফিক (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “আল ইয়াকিন বা আরসার নেতারা শুধু হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ও মেসেঞ্জারে ভিডিও বার্তা প্রচার করে আরাকানের যুবকদের জিহাদ করতে উস্কিয়ে দিয়েছেন। সংগঠনটির কোন নেতা আমাদের কাছে পরিচিতও নয়। ওদের কাউকে এলাকায়ও আসতেও দেখেনি কেউ। শুধু পাহাড়ি ঝোঁপঝাড় থেকে কয়েকটি অস্ত্র হাতে নিয়ে ভিডিওতে জিহাদ করতে বলেছেন।”
রফিক আরো বলেন, “রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠনের নেতা পরিচয় দানকারী আতা উল্লাহ ভিডিওতে জিহাদের ডাক দিয়ে বলেছেন রোহিঙাদের সাথে মিয়ানমারের বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হলে হাজার হাজার প্রশিক্ষণ নেয়া আল ইয়াকিন সদস্য অস্ত্র সজ্জিত হয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ করবেন, আরাকান রাজ্য স্বাধীন করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। সরকারি বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম ছাঁই করে গেছে তবু আল ইয়াকিন বা আরসা’র কোন সদস্যকে কোন গ্রামেই সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে আসতে দেখেনি রোহিঙ্গারা।”
মংডুর কাইন্দা পাড়া থেকে আসা সা’দ (নাম পরিবর্তিত) বলেন,“আরসা বা আল ইয়াকিন কে আরাকানের মুসলমানদের কল্যাণকামী সংগঠন বলে মনে হয়না। তাদের অসংগঠিত ও অপরিকল্পিত সন্ত্রাসী কান্ডের খেসারত দিতে হয়েছে লাখ লাখ নিরপরাধ রোহিঙ্গাকে। আল ইয়াকিন বা আরসা এ ঘটনাটি না ঘটালে মিয়ানমার সরকার আপাতত রোহিঙ্গাদের উপর এতো পাশবিক নির্যাতনের পথ বেছে নিতো না বলেও ধারণা সা’দের। তার মতে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই দূরাবাস্থা শুধু আল ইয়াকিন (আরসা)’র কারণে হয়েছে।”
সা’দ আরো বলেন, “ওপারে অনেক রোহিঙ্গাদের বড় বড় অট্টালিকা, ব্যবসা বাণিজ্য, ধন-দৌলত সবকিছুই ছিলো। কিন্তু আল ইয়াকিন (আরসা)’র ভুলের কারণে হোক বা তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে হোক, আরাকানে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব শেষ হয়েছে মুলত আল ইয়াকিন (আরসা)’র কারণে। সরকারের নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়াতো দূরের কথা উল্টো দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের।
তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার কতটা বর্বর তা সবাই জানে, তাই পুরো প্রস্তুতি ছাড়া সরকারের একটি বৃহত্তর বাহিনীর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করা মাতলামি ছাড়া কিছুই না। আমার মতে, আরসা নেতা আতা উল্লাহ নিজের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে কাজটি করেছিলেন। তা না হলে, যখন সরকারি বাহিনী হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্বিচারে হত্যা করছে তখনও আল ইয়াকিন (আরসা) নামক সংগঠনটি পাহাড়ে লুকিয়ে খেলা দেখছিল।”
গদুছড়া থেকে পালিয়ে আসা আরেক যুবক সাঈফ (নাম পরিবর্তিত) বলেন, “ আল ইয়াকিন (আরসা) আমাদের শুধু যুদ্ধ করতে বলেছে কিন্তু তারা আমাদের সামনেও আসেনি, যুদ্ধের কোন রণকৌশলও শেখাননি। আমাদের তারা শুধু খালি হাতে তাদের সঙ্গ দিতে বলেছিল তাও ভিডিও প্রচার করে। আমাদের হাতে দা, চুরি, লাঠি ছাড়া কিছুই ছিলোনা। আমরা প্রথমে নিরব ছিলাম , যখন রাখাইনরা সরকারি বাহিনীর সাথে মিলে আমাদের উপর হামলা করলো তখন আমরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলাম , কিন্তু তাদের ভারি অস্ত্রের সামনে আমরা নিরুপায়। বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া ছাড়া আমাদের সামনে কোন উপায় ছিলোনা।”
তিনি আরো বলেন, “আরসার নেতারা কারো কারো হাতে নাকি বোমা বলে কালো পলিথিনে মোড়ানো মাটির বুনট পৌঁছিয়েছিলো। এগুলো পাঠিয়ে তারা বলেছিলো,‘এগুলো বোমা, ছুড়ার সাথে সাথে সব কিছু জ্বলে ছাঁই হয়ে যাবে’। যখন আল ইয়াকিন (আরসা)’য় আশ্বস্ত গুটি কয়ে রোহিঙ্গা যুবক হাতে থাকা এসব বোমা সদৃশ বস্তুগুলো নিক্ষেপ করে, তখন দেখা গেলো পলিথিন ছিড়ে মাটি ছাড়া কিছুই বেরোইনি। এই যুবকের মতে, আল ইয়াকিন (আরসা) মুলতঃ রোহিঙ্গাদের সাথে চরম বেঈমানি করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের মুক্তির কথা বলে বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা ধান্ধা করার ফন্দি করেছিল।”
মিয়ানমারে সহিংসতার পর এদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবক ও পুরুষদের কাছে প্রশ্ন করা হলে তারা কেউ আরসা বা আল ইয়াকিনের সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারেননা। তারা শুধু এটুকু বলতে পারেন যে, আল ইয়াকিন ( আরসা) নামে একটি সংগঠন আছে যেটি রোহিঙ্গাদের মুক্তির কথা বলেছিলেন। রোহিঙ্গারা জানতেন না যে আল ইয়াকিন ( আরাসা)’র রোহিঙ্গা মুক্তির মিশন যে রোহিঙ্গা নিধনের মিশনে পরিণত হবে।
রোহিঙ্গারা এখন আল ইয়াকিন (আরসা) তে মোটেও আস্থা রাখছেননা বরং এ সংগঠনের সদস্যদের খোঁজ পেলে খতম করে দেবেন বলেও কেউ কেউ ক্ষোভ দেখিয়েছেন এই বলে যে, আল ইয়াকিন (আরসা) রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন।
এপারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রশ্ন ; আরসা কি বাস্তবেই রোহিঙ্গাদের মুক্তি চেয়েছেন নাকি তারা মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নিধন পরিকল্পনার অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করেছেন ?
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।