মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। কিন্তু এই সংকট নিরসনে এখন পর্যন্ত কার্যত কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করায় সঙ্গত কারণে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাকা। তবে এর বাইরে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে নিন্দা ও সমালোচনা করেছে তুরস্ক। আর তা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। একের পর এক বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের আন্তর্জাতিক কণ্ঠে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। রোহিঙ্গা সংকটে তুরস্কের নেতৃত্বস্থানে আসতে চাওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ বিশ্লেষণ করে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক অলাভজনক ও গবেষণাধর্মী সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে রোহিঙ্গারা জাতিগত নিধনের শিকার হচ্ছে বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেইনের বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য এসেছে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্থনিও গুয়েতেরেজের বিবৃতিতেও। পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো ধীরগতিতে ও দ্বিধাগ্রস্ত প্রতিক্রিয়া জানালেও বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এসব দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান।
তুরস্কের ত্রাণ সহযোগিতা
তুর্কি সরকারের বিবৃতিতে অনুযায়ী, মিয়ানমারের মানবিক ত্রাণ পাঠানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে অনুমতি পেয়েছেন এরদোয়ান। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে জাতিসংঘের সব ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যেই ৭ সেপ্টেম্বর তুরস্কের বিদেশি সহযোগিতা সংস্থা টিকা প্রথম দেশ হিসেবে রাখাইন অঞ্চলে ১ হাজার টন খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধ পাঠিয়েছে।
এছাড়া তুরস্ক বার বার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবিক ত্রাণ বিতরণের ঘোষণা দিয়েছে। বিষয়টি আরও আলোচনায় আসে যখন এরদোয়ানের স্ত্রী তুর্কি ফার্স্টলেডি এমিনি এরদোয়ান নিজেই বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
প্রকাশ্য নিন্দা
অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) বর্তমান প্রধান হিসেবে কাজাখাস্তানে সর্বশেষ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন। এরদোয়ান নিজেই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন সম্মেলনে। এর আগে এরদোয়ান রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছিলেন।
২৫ আগস্ট সংকট শুরুর পরই তুর্কি প্রেসিডেন্ট মুসলিম বিশ্বনেতাদের ঐক্যবদ্ধ করতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। ৩১ আগস্ট তিনি মৌরিতানিয়া, পাকিস্তান, ইরান ও কাতারের রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলেন টেলিফোনে এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা দমনের উপায় বের করার আহ্বান জানান।
এরদোয়ানের পাশাপাশি তুরস্কের অনেক কর্মকর্তাও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ খুলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভাসোগলুর মন্তব্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। এছাড়া উপ-প্রধানমন্ত্রী মেহমেদ সিমসেক অপ্রাসঙ্গিক একটি ছবি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে টুইট করে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন।
বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের সরে যাওয়ার ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে তা এক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু মূলত তুরস্কের দীর্ঘদিনের পশ্চিমাপন্থী মনোভাব পাল্টে গেছে। তুরস্ক পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য এবং কয়েক বছর ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহী ও চেষ্টায় ছিল। কিন্তু এরদোয়ানের নেতৃত্ব ও ক্ষমতাসীন একেপি সরকারের পররাষ্ট্রনীতি এখন দক্ষিণমুখী হয়ে পড়েছে নতুন সুবিধা লাভের আশায়।
বিলকেন্ট ইউনিভার্সিটির অ্যাকাডেমিক পিনার বিলজেন ও আলি বিলজিক তুরস্কের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে ‘সিভিলাইজেশনাল জিওপলিটিকস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যা সংস্কৃতি ও সভ্যতার মাপকাঠিতে আন্তর্জাতিক আচরণ নির্ধারণের পন্থা।
বিলজিন ও বিলজিক যুক্তি তুলে ধরে বলেন, নতুন এই মতবাদ তুরস্ককে পশ্চিমা ও এশিয়ার বাকি অংশের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রে স্থাপন করেছে। রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মাধ্যমে এই বৈশ্বিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে সেন্ট্রাল এশিয়ান ও অটোমান ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে।
তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তন শুরু হয় একুশ শতকের প্রথম দশকের শেষ দিকে। এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছেন ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী (২০০৯-১৪) আহমেদ দাভুতোগলু। তুরস্কের বৈশ্বিক জাগরণে ২০১০ সালে নেওয়া পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্ব অপরিসীম এবং এই নীতির মস্তিষ্ক মনে করা হয় তাকে।
দাভুতোগলুর সময়ে তুরস্কের বৈশ্বিক কূটনৈতিক ব্যাপ্তি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকায়। ২০১২ সালে তিনি মিয়ানমারে তুরস্কের প্রথম দূতাবাস চালু করেন। এর মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের যাত্রা ও রোহিঙ্গা ইস্যু—উভয় সুবিধা আদায় করেন।
২০১৩ সালে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দাভুতোগলুর একাধিক সফর করেছেন। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এটি ছিল তুরস্কের নতুন পররাষ্ট্রনীতি। বৈশ্বিক মানবিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার দীর্ঘদিনের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ ছিল তুরস্কের। তুর্কি বিশেষজ্ঞ ই ফুয়াত কেইম্যান ও অনুর জাকাক এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ‘মানবিক রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দাভুতোগলুর নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে সেই ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’র প্রতিফলন উঠে আসে।
তুরস্কের মানবিকতার প্রতি এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন সাংবাদিক ও সাবেক সোমালি পরিকল্পনামন্ত্রী আবদিরহমান আলি। তিনি তুরস্কের মানবিক সহযোগিতা পদ্ধতিতে পশ্চিমা ও চীনা ত্রাণ সহযোগিতা মডেলের মাঝামাঝি বলে চিহ্নিত করেছেন। পশ্চিমা ও চীনের ত্রাণ সহযোগিতা কঠিন শর্তযুক্ত, আমলাতান্ত্রিক ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট। যা শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি ও স্বৈরাচার শাসকদের হাতে গিয়ে পড়ে। বিপরীতে আলীর দাবি, তুরস্ক এক্ষেত্রে ‘‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করে মানবাধিকার রক্ষা ও দুর্বলকে সহযোগিতা করার ‘নৈতিক’ অবস্থানকে গুরুত্ব দেয়।”
গত পাঁচ বছরে তুরস্ক নিজেদের এই ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ বাস্তবায়নে সহযোগিতার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি এনজিও ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বে মানবিক সহায়তাকারী দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তুরস্ক। এই খাতে দেশটি ব্যয় করেছে ৬ বিলিয়ন ডলার। শীর্ষ সহযোগিতাকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহযোগিতায় ব্যয় করেছে ৬.৩ বিলিয়ন।
মুসলমানদের অধিকারের ‘চ্যাম্পিয়ন’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে এরদোয়ানের উচ্চকিত কণ্ঠের আরেকটি কারণ হচ্ছে, তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। সত্যিকার অর্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এরদোয়ানের প্রকাশ্য বক্তব্য একেবারেই নিজের স্বার্থে। বিশ্বের যেকোনও স্থানের মুসলমানদের জন্য শক্তিশালী তুরস্কের ভাবমূর্তি দেশটির রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তুরস্কের নেতা হিসেবে এরদোয়ানের ১৫ বছরের শাসনামলে একসময় কোণঠাসা হয়ে পড়া মুসলমানরা মিডিয়া, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
মুসলিম বিশ্বের বিরাট অংশের জনগণের মতের কথা বাদ দিলেও তুরস্কের অতি-উৎসাহী সমর্থকদের কাছে যেকোনও মুসলমানের অধিকারের জন্য এরদোয়ান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
এরদোয়ান দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও গবেষণায় বিভিন্ন সংকটের মুহূর্তে নিজেরে এই ভাবমূর্তি গড়ে তোলেছেন। যেমন—২০১১-১২ সালে মিসরে মুরসি শাসনামল বা ফিলিস্তিন। ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়ার কারণে আরবি দৈনিক পত্রিকার ফিলিস্তিনপন্থী কলাম লেখকদের কাছে এরদোয়ান ‘নয়া নাসের’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন।
সামনে রয়েছে প্রতিযোগিতা
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রোহিঙ্গা সংকটে মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সম্প্রতি পিছিয়ে পড়েছে সৌদি আরব। তবে এবারের সংকটে তুরস্ক নেতৃত্বে চলে আসায় সৌদি আরবও প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। তুরস্কে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। যাতে সৌদি আরবের শক্তি ও রোহিঙ্গাদের প্রতি দীর্ঘদিনের সমর্থনের কথা গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। এগিয়ে এসেছে ইরানও। তেহরান ঘোষণা দিয়েছে শিগগিরই ত্রাণবাহী জাহাজ মিয়ানমারে পাঠাবে।
এরদোয়ান ঘোষণা দিয়েছেন আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলে ধরবেন। তবে অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি।
বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের রক্ষার জন্য এরদোয়ানের আহ্বান তুরস্কের কূটনৈতিক নেতৃত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্যান্য মুসলিম দেশ তাকে অনুসরণ করবে, নাকি তুরস্কের তথাকথিত ‘মানবিকতার রাজনীতি’ প্রত্যাখ্যান করবে, তার ওপর নির্ভর করছে এরদোয়ানের মুসলিম বিশ্বের নেতা হয়ে ওঠা।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।