ডেস্ক নিউজ:
‘সর্দি, কাশি কিংবা জ্বর হলেই গলির ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়ে নিতাম। নিজে তো খেতামই, ঘরের কেউ অসুস্থ হলেও ওই গলির দোকানেই যেতাম। এমনকি দেড় বছরের কোলের ছেলেকেও ওষুধ খাইয়েছি চিকিৎসকের পরার্মশ ছাড়াই। কিন্তু এখন জানতে পেরেছি, এর মাধ্যমে হয়তো নিজের হাতেই মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে এসেছি। চিকিৎসকের পরার্মশ ছাড়া, অনির্ধারিত মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যে মৃত্যুর সমান— এটা আমার যেমন জানা ছিল না, তেমনি হয়তো অনেকেরই তা জানা নেই। তাই আপনারা সবাইকে এই তথ্য জানান। নইলে একসময় অ্যান্টিবায়োটিক না পেয়ে যেমন মানুষ মারা যেত, তেমনি ভবিষ্যতে হয়তো এমন সময় আসবে যখন মাত্রাছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে তা হারাবে কার্যকারিতা, হয়ে উঠবে মৃত্যুর কারণ।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রায়হান মাহমুদ। শুধু তিনিই নন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ‘সেলফ মেডিকেশন’ হয়ে উঠতে পারে বিপর্যয়ের কারণ। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগে সচেতনতার অভাব এর কার্যকারিতাকেই নষ্ট করে দেবে। এতে করে আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন অসুস্থতায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার জরুরি। তবে অ্যান্টিবায়োটিকের রয়েছে বয়সভেদে নির্ধারিত মাত্রা। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ক্ষেত্রে এই মাত্রা অনুসরণ করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি পুরো মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ। আর এগুলো অনুসরণ না করলেই কার্যকারিতা হারায় অ্যান্টিবায়োটিক। তাতে মানবশরীরে গড়ে ওঠে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেলফ মেডিকেশনের কারণে মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হচ্ছে। তবে এ কারণে দেশে কত মানুষ মারা যায়, তা নিয়ে কোনও গবেষণা নেই। অবশ্য মার্কিন এক প্রতিবেদন বলছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে বছরে বিশ্বে সাত লাখ আর বাংলাদেশে ২৩ হাজার মানুষ মারা যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ওষুধ প্রযুক্তি অনুষদের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ভুল অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে মানুষের অসুস্থতার হার বেড়ে যায়, বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়। এতে করে মৃত্যু হারও বাড়ে। অন্যদিকে, এক থেকে চার বয়সী শিশুদের ওপর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ হয় বেশি।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগের ভয়াবহতা সর্ম্পকে বলতে গিয়ে ঢাবির ওষুধ প্রযুক্তি অনুষদের অধ্যাপক ড. সিতেশ চন্দ্র বাছার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সহজেই হাতের কাছের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনতে পারি, যেটা উন্নত বিশ্বের কোথাও দেখা যায় না। আর অ্যান্টিবায়োটিককে বলা হয় সোস্যাল ড্রাগ। কারণ, অ্যান্টিবায়োটিক খেতে খেতে মানুষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তখন আর কোনও অ্যান্টিবায়োটিক তার শরীরে কাজ করে না। তাই অ্যান্টিবায়োটিক সর্ম্পকে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। মানুষ যেন নিজে নিজে কোনও ওষুধ না খায়, সেজন্য মানুষকে সচেতন করতে হবে। এ দায়িত্বটাও চিকিৎসকসহ গণমাধ্যমেরও।’ বাংলাদেশসহ এশিয়ার ১১টি দেশে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে বলে জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেলফ মেডিকেশন বা নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া আমাদের সমাজে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। কিছু হলে আমরা নিজেরাই গিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে আনছি। অথচ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনও ওষুধ বিক্রি করা যাবে না বলে বলা আছে।’ একজন রোগী না বুঝেই ফার্মেসি থেকে নিজে নিজে ওষুধ কিনলেও বিক্রেতারা মুনাফার জন্য ওষুধ বিক্রি করে থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে সেলফ মেডিকেশনের ভয়বহতা বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন অনুষদের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গর্ভবতী নারী ও যেসব মায়ের সন্তান বুকের দুধ পান করে, তাদের একেবারেই নিজে নিজে কোনও ওষুধ খাওয়া চলবে না। অন্যদিকে, কোনও অবস্থাতেই শিশুদের জ্বর বা সর্দি-কাশির জন্য ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে এনে খাওয়ানো যাবে না। এতে করে তাদের শরীরে সঠিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। একইসঙ্গে ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক বদল করাও ঠিক নয়। এতে শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তাতে করে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।