রফিক মাহমুদ,উখিয়া :

মিয়ানমারের আরকান রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার মোবাইল ফোন ও বাংলাদেশী অপারেটরদের সিম ব্যবহার করছেন। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেই তারা কিনতে পারছেন এদেশের অপারেটরদের সিম। মূলত যোগাযোগের তাগিদ থেকেই তারা এসব সিম কিনছেন বলে জানা গেছে।

অনুসন্দানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের হাতে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশী সিম তুলে দিচ্ছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় কোনও ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই এসব সিম বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর নিবন্ধন না থাকায় এসব সিম ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ কেউ। রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য দালালদের দারস্ত হয়। এ দালালরাই তাদের বন, জঙ্গল, পাহাড় ও নদী পাড় করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত সিম ও মোবাইলের ব্যবস্থাও তারা টাকার বিনিময়ে করে দেন। তাই কখনও কখনও বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই এদেশের সিম পান তারা।

মংডুর চারখম্ব এলাকা থেকে কামাল হোসেন (২৫) নামে যুবক গত একসপ্তাহ আগে বাংলাদেশে এসেছেন। তার স্ত্রীর নাম আয়েশা। পরিবারের ৯ জন কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্প সংলগ্ন আম গাছতলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাকে মোবাইলে কথা বলতে দেখা গেল। এসময় তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মোবাইল ও সিম কেনার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারেই আমার মোবাইল ছিল। বাংলাদেশে আসার পর একজনের কাছ থেকে ১৫০ টাকায় একটি সিম (রবি) কিনেছি।’ কার কাছ থেকে সিম কিনছেন? জানতে চাইলে কামাল হোসেন বিক্রেতার নাম বা মোবাইল নম্বর দিতে পারেননি। তবে তিনি জানান, মূলত দালালরা গোপনে সিম ও মোবাইল প্যাকেজ আকারে বিক্রি করছেন। রোহিঙ্গারাও এর সুযোগ নিচ্ছেন।

মো. রহিম (২১) দশদিন আগে বাংলাদেশে এসে দেশড় টাকায় একটি সিম (বাংলালিংক) কিনে ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবারের সবাই হারিয়ে যায়, তাই মোবাইল দরকার। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে মোবাইল দরকার।’

কামাল ও রহিমের মত শতশত রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারীদের হাতে মোবাইল ফোন ও বাংলাদেশি সিম দেখা গেছে। অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাফ নদীর উপকূলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। অনেকে মিয়ানমারে বসেও বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করেন।

মো. রফিক নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘বর্ডার থেকে দুইশ টাকায় সিম (বাংলালিংক) কিনেছি। বর্ডারে সিম কিনতে পাওয়া যায়। কোনও কাগজপত্র লাগে না। সিম খুব ভালোই চলছে।’ তিনি জানান, বেশিভাগই (বাংলালিংক) সিম পাওয়া যাচ্ছে। তবে অন্য সিম পাওয়া যায়না তা নয়।

শরণার্থী হয়ে আসা রোহিঙ্গারা হাতে, পকেটে, গলায় ঝুলিয়ে রাখছে মোবাইল। নারীরাও মোবাইল ব্যবহার করছেন। তারা গায়ে পরিহিত পোশাকের ভেতরে মোবাইল গুজে রাখেন। প্রয়োজনে বের করেই কথা বলছেন। তারা মোবাইল অপারেট করতেও পারদর্শী। মোবাইল নম্বর মুখস্ত না থাকায় সংখ্যা ডায়েল করে মোবাইল নম্বর বের করে দিতে পারেন।

গতকাল দুপুরে কুতুপালংয়ের রাস্তায় ত্রাণের জন্য বসে থাকা নারীদের মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায়। এসময় পরিচয় জানতে চাইলে বোরকা পরা এক নারী জানান, তার নাম হাফিজা খাতুন। মোবাইল কোথায় পেয়েছেন? জানতে চাইলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেন। পরে তিনি আর কোনও কথা বলতে রাজি হননি।

তবে মোবাইল ও সিম সংগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করে নূর কামাল হোসেন (৩০) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘আমার বাবার নাম হোসেন আহমেদ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডংয়ে কোয়ারবিল এলাকায় আমাদের বাড়ি। বাবা-মা ও ভাইবোনসহ মোট ৯ জন বাংলাদেশে এসেছি। একটি মোবাইল ও সিম (বাংলালিংক) পাঁচহাজার দুইশ টাকায় কিনেছি। যার মধ্যে কুতুপালংয়ের বাজারের একটি দোকান থেকে সিমটি দুইশ টাকায় কিনেছি।’ সিম কিনতে কাগজপত্র বা ছবি দিতে হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, কোনও কাগজপত্র লাগেনি।’

মংডুর চাইরকম্ব এলাকা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ইসমাইল হোসেন (১৪)। বাবা তৈয়মুল্লাহ-র সঙ্গে সেখানে হালচাষ করতেন। তার পরিবারের ৮জন কুতুপালং নতুন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তার হাতেও মোবাইল ফোন দেখা গেল। তিনি বলেন, ‘নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীদ্বীপে প্রথমে একদিন ছিলাম। সেখান থেকে এক ব্যক্তির কাছ থেকে সিমটি (রবি) কিনে নিয়েছি। সিম কেনার সময় বিক্রেতা কোনও কাগজপত্র চাননি।’

কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনের সড়কেই অনেকগুলো মোবাইল সার্ভিসিং ও রিচার্জের দোকান রয়েছে। যেখান থেকে রোহিঙ্গারা সিম কিনছেন। কুতুপালংয়ের আমগাছ তলা ক্যাম্পের সামনের একটি দোকানে ভিড় দেখে সেখানে গেলে দেখা যায়, রোহিঙ্গা যুবকরা মোবাইলে রিচার্জ করছেন, কেউ গান নিচ্ছেন, কেউ সিম কিনছেন। মোবইল খুলে সিম সংযোগ করে দিচ্ছেন দোকানি। দোকানের ভেতরে দুই যুবক ও এক শিশুর সঙ্গে পরিচয় হয়। সে সময় জুয়েল নামে এক যুবক (দোকানদার) বলেন, ‘আমি কোনও সিম বিক্রি করি না।’ এ সময় তিনি ইশারায় রোহিঙ্গাদের চলে যেতে বললে দোকান খালি হয়ে যায়।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘এভাবে সিম বিক্রিতে ঝুঁকি আছে। কারণ যেসব নাগরিক সুবিধা আমার ভোগ করি, তারাও সেটা চাইবে। বৈধভাবে না পেলে তারা অবৈধভাবে পেতে চাইবে। তাই একটা বৈধ প্রক্রিয়া শুরু করা উচিৎ। অনেক দেশ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সিম দিয়ে থাকে। এরপর সেট ব্লক হয়ে যায়। আমরা সেটাও করতে পারি। তবে তাদের নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত করা যাবে না। তাহলে দালাল ও অবৈধ পথ উৎসাহিত হবে।’

এ বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘এগুলো নজরদারির জন্য মোবাইল অপারেটরদের নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে। তারপরও আমরা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’

প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ২৯টি চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, বোমা নিক্ষেপ, গুলি করে ও গলা কেটে রোহিঙ্গাদের হত্যার অভিযোগ উঠে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা দলেদলে বাংলাদেশে আসা শুরু করে। এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই সংখ্যা দশ লাখ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাগুলো। প্রতিদিনই রাখাইন রাজ্যের কোনও না কোনও অঞ্চলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে।