ডেস্ক নিউজ:

তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের এক নিখুঁত প্রতীক। খুবই বুদ্ধিমতী। পড়াশুনা আছে। কথা বলার কণ্ঠটা স্পষ্ট। আর চেহারাটা ফটোজেনিক। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে, বার্মার হিংস্র জেনারেলরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ভালো কভারেজ পাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারতেন না। অবশ্য, তারা কখনও চেষ্টা করেছে কিনা সন্দেহ। আমরা যারা মিয়ানমারে থেকে গোপনে কাজ করেছি, তারা মনে করতে পারি গুপ্ত পুলিশ আর গোয়েন্দাদের ব্যাপারে আমাদের সার্বক্ষণিক তটস্থ থাকার স্মৃতি। আমাদের সামরিক জান্তা রীতিমতো ঘৃণা করতো।

১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে গৃহবন্দিত্ব থেকে প্রথমবারের মতো মুক্তি পান অং সান সুচি। এর কিছুকাল পরই আমার সঙ্গে তার প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎ হয়। তখন নেলসন ম্যান্ডেলার পর তিনিই ছিলেন স্বৈরশাসকের প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শনের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আইকন। বিশ্ব মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত উঠে আসতো কিভাবে তার দিকে রাইফেল তাক করে রাখা সেনাদের মোকাবিলা করছেন তিনি। জাতিসংঘ ও অন্য সংস্থাগুলো তার গৃহবন্দিত্ব অবসানের দাবি জানাতো। এই লক্ষ্য অর্জনে এই সংস্থাগুলোকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। নিজের লেক-লাগোয়া বাড়ির ফটকে দাঁড়িয়ে সুচিকে সহিষ্ণুতা ও শৃঙ্খলার গুরুত্ব নিয়ে বক্তৃতা দিতে শুনেছি। নব্বইয়ের দশকে আমাকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারে তিনি বারবার অসহিংসতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিভাবে নেলসন ম্যান্ডেলার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, আমার কাছ থেকে তা জানতে সব সময় মুখিয়ে থাকতেন তিনি। কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল আমার পূর্বতন কর্মস্থল। তার মুখ থেকে ‘ভয় থেকে মুক্তি’ (ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার) শব্দগুচ্ছটি বারবার বের হতো। এক পর্যায়ে এটি হয়ে যায় তার বেস্ট সেলিং বইয়ের শিরোনাম।

এ ধরনের ভাষাই আমিসহ অন্যান্য পশ্চিমা সাংবাদিকরা শুনতে অধীর হয়ে থাকতাম। তখন যারা মিয়ানমারে গেছেন সংবাদ সংগ্রহ করতে, তাদের অনেকেই আগে রুয়ান্ডা ও বলকানের ট্র্যাজেডি কভার করেছেন। সেখানে গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলাভিযান চাক্ষুষ করে এসেছি আমরা। তাই এই ভদ্রমহিলার কথা আমাদের ভীষণ টানতো।

সুচি শান্তির দূত ছিলেন এমন এক বিশ্বে, যেটি কিনা সার্বিয়ার স্লোবোদান মিলোসেভিচ, ক্রোয়েশিয়ার ফ্রাঞ্জো তুজম্যান বা রুয়ান্ডার হুতু চরমপন্থিদের কর্মকাণ্ডে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু আজ মনে হয়, মিয়ানমার ও দেশটির জটিল জাতিগত দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানতাম। দারিদ্র্য এই দ্বন্দ্বকে আরো জটিল করে তোলে। আর এই দ্বন্দ্বকেই দশকের পর দশক ধরে ব্যবহার করেছে সামরিক শাসকরা। এমনকি আজ মনে হয়, খোদ অং সান সুচি সম্পর্কেও আমরা খুব কমই জানতাম।

যেই জেদ থাকায় তাকে সামরিক জান্তা নতি স্বীকার করাতে পারেনি, সেই জেদই যে একদিন তিনি ক্ষমতায় গেলে বিদেশি সমালোচনার মুখে একইভাবে সক্রিয় হয়ে উঠবেন, তা আমরা সেদিন ভাবতেই পারিনি। তার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটিই হয়ে যেতে পারে তার দুর্বলতম স্থান। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনে তার পুরোনো অনেক বন্ধুবান্ধব ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক রাজনীতিক এখন তার কড়া সমালোচনা করেন।

তার সান্নিধ্যে ছিলেন এমন যে কেউ জানেন যে, তিনি যদি কোনো কিছুতে মনস্থির করে ফেলেন, তখন তাকে সেখান থেকে ফেরানো প্রচণ্ড কঠিন। গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত বিজয় নাম্বিয়ার রাখাইন রাজ্য সফরের আহ্বান জানান সুচিকে। জবাবে কড়া গলায় তা প্রত্যাখ্যান করেন সুচি।

তার ঘনিষ্ঠদের একজন আমাকে বলেছেন, ‘নাম্বিয়ার তাকে যা করতে বলেছেন, তিনি তা করবেন- নিজেকে কখনই এভাবে ফুটিয়ে তুলতে চাইবেন না তিনি।’ একইভাবে তিনি কখনই এটি মানবেন না যে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা একটি জাতিগত নির্মূল প্রক্রিয়ার শিকার। এমনকি শত সহস্র বাড়িঘর পোড়ার পরও নয়। ব্যাপকহারে হত্যাযজ্ঞ ও যৌন সহিংসতার খবর সত্ত্বেও নয়।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে এবারই প্রথম তিনি সমালোচনার মুখে পড়লেন, তা নয়। পাঁচ বছর আগেও প্রায় একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তখন এক অভিযানে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়। সুচি সেবারও রাখাইন সফর করেননি, নির্যাতিতদের পক্ষে কথা বলেননি।

তার সরকার বৌদ্ধ চরমপন্থিদের বিদ্বেষসূচক বক্তব্য (হেইট স্পিচ) রোধে পদক্ষেপ নিয়েছে বটে। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি যাকে মুসলিমদের প্রতি সমর্থনসূচক বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। অথচ, ভারত ভাগের সময় সহিংসতা চলাকালে নির্যাতিতদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিলেন তার আদর্শিক নায়ক মহাত্মা গান্ধী ও জওহর লাল নেহরু। নিজের এই পদক্ষেপের মূল্য গান্ধী দিয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়ে।

কংগ্রেস নেতারাও গণহত্যা বন্ধে সফল হননি। কিন্তু পার্টিশনের পর ভারতের যেই মূল্যবোধ দেখতে চেয়েছিলেন এই দুই নেতা, তার স্বাক্ষর তারা ঠিকই রাখতে পেরেছেন। জাতিগত সহিংসতা প্রতিরোধে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে নেহরু যা করেছিলেন, সেটি বিংশ শতাব্দীতে ব্যক্তিগত সাহসিকতার অন্যতম নিরূপণীয় নিদর্শন।

কেউই অং সান সুচির কাছ থেকে একই মাত্রার সাহসিকতা আশা করছে না। কিন্তু প্রতীকী বা মৌখিক হস্তক্ষেপ করার তাগিদও তার নেই- এটিই তার সাবেক সমর্থকদের মর্মপীড়ার কারণ।

রোহিঙ্গারা যেই যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, তা এমনিতেই এক ট্র্যাজেডি। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে আগুনের কালো ধোঁয়ায় সামরিক বাহিনীর ছায়া টের পাওয়া যায়। এই সামরিক বাহিনী মনে করে, বিশ্ব যা-ই বলুক না কেন, পুরোনো সেই নিষ্ঠুর কায়দায় তারা নৃশংসতা চালিয়ে যেতে পারবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যেই তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে তা শিগগিরই হয়তো কারেনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিংবা শান রাজ্যসহ মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছেও পরিচিত দৃশ্য হয়ে দেখা দেবে।

অং সান সুচি সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। তারাও সুচিকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের নথিবদ্ধ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিন্দা জানাচ্ছেন না। আর এতেই জেনারেলরা পেয়ে যাচ্ছেন নিজেদের কৃতকর্মের রাজনৈতিক আচ্ছাদন।

শুধু নীরবতাই নয়। সুচির কূটনীতিকরা রাশিয়া ও চীনকে নিয়ে জাতিসংঘে কাজ করছেন যাতে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সরকারের কোনো সমালোচনা না আসে। তিনি নিজেও সাম্প্রতিক সহিংসতাকে সন্ত্রাসবাদের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

তিনি মনে করছেন, তার যেসব সমালোচনা করা হচ্ছে সে সবের কোনো ভিত্তি নেই। আর এ কারণেই এই সমালোচনার মুখে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তার পুরোনো জেদ। এটিও কিন্তু পুরো সমীকরণের অংশ।

কিন্তু আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নও করার আছে। সার্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি তিনি অনেক আগেই নিজের অঙ্গীকারের কথা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এই অঙ্গীকার কি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির রোহিঙ্গা মুসলিমদের বেলায় প্রযোজ্য নয়, কিংবা কখনও হবে না? তিনি হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন নৃশংস দমনপীড়ন রুখতে সামরিক বাহিনীকে চাপ দেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এই মুহূর্তে, তেমনটি হওয়ার লক্ষণ সামান্যই।

ফার্গাল কিন বিবিসি’র একজন বৈদেশিক প্রতিবেদক। তার নিবন্ধটি বিবিসি’র ওয়েবসাইট থেকে অনূদিত।