রোহিঙ্গা শিবিরে অভুক্ত মানবতার হাহাকার!

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০৮:০৭ , আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০৮:২৫

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিল কোস্টট্রাস্ট। বিতরণের উদ্দেশ্যে একটি প্যাকেট হাতে নিলেই উম্মুখ ক্ষুধার্ত মানবতার হাতগুলো। চলছে খাবারের জন্য হাহাকার। ছবিটি শনিবার বিকালে কুতুপালং এলাকা থেকে তোলা। -সিবিএন।

ইমাম খাইর, সীমান্ত থেকে ফিরে:
ওরা রোহিঙ্গা, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি। ভাসমান এই জাতির নেই অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা। রাত-দিন কাটছে পথের ধারে। দু’মুঠো ভাতের জন্য উম্মুখ তারা। খাবার ও পানীয় জলের জন্য হাহাকার চলছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের মাঝে।
উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এখন রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। দুচোখ যে দিকে যাবে শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাবে। কোলে শিশু নিয়ে, কাঁধে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে ছুটছে আশ্রয়ের আশায়। সম্বল বলতে পরনের কাপড় ছাড়া কিছু নেই তাদের। সড়কে খাদ্যবাহী কোন গাড়ি দেখলে পেছন পেছন ছুটছে তারা।
সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সংবাদকর্মীদের গাড়ি থামিয়ে জানালায় খাবার আর পানির আকুতি জানাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ সংখ্যায় নারী-শিশুদের পরিমাণ বেশী। কখনও কখনও সংবাদকর্মীদের কাপড় টেনে ধরে থামাতে চাইছে। নারীরা তাদের বাচ্চাদের দেখিয়ে খাবার ভিক্ষা চাইছে।
কক্সবাজার শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশে উখিয়ার কাস্টমস ঘাট। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সম্প্রচার উপকেন্দ্রের অবস্থান এখানে। এই কেন্দ্রের বিপরীতে রাবার বাগানে বাঁশ আর পলিথিন মুড়িয়ে তৈরী করা হয়েছে নতুন রোহিঙ্গাপল্লী। এখানে আশ্রয় নিয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গা।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় পায়নি, তাদের একটি অংশ রাবার বাগানে আশ্রয় নিয়েছে।

দুই দিন উপুষ থাকার পর একটি খাবার প্যাকেট পেল রোহিঙ্গা রহিম উল্লাহ পরিবার। দু’মুটো ভাত ভাগ করে খাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা।

শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দুই পাশে রোহিঙ্গাদের স্রোত। কেউ মাথায় ঝুঁড়ি, কাপড়-চোপড় নিয়ে হাঁটছে। খোঁজছে আশ্রয়স্থল। কেউ খাবারের টাকার জন্য হাত পাতছে। গাড়ি দেখলেই তারা ছুটে যাচ্ছিল খাবার, পানীয় ও রসতপাতির আশায়।
শনিবার রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরী খিচুড়ির প্যাকেট নিয়ে কুতুপালং এলাকায় হাজির হয় দেশের অন্যতম বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা-কোস্টট্রাস্ট। বেলা দুইটার দিকে খাবারবাহী ট্রাকটি মাঠে পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে জড়ো হয় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। ঘিরে ধরে ওই ট্রাকটিকে। ওখানে কোস্টট্রাস্টের সৌজন্যে বসানো হয় ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্প।
এদিকে, রাখাইনের সহিংসতা থেকে বাঁচতে স্রোতের মতো ধেয়ে আসা বিপন্ন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষরা অমানবিক দিন যাপন করছেন বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে। প্রয়োজনীয় খাবার আর পানির অভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। কোনও রকমে নিজেদের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিলেও তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার পথ পাচ্ছে না। এমন বিপন্নতার মধ্যেই বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ৫৭ কোটি ১২ লাখ টাকার সহায়তা ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। তবে এই সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা স্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, এই বিপুল পরিমাণ মানুষকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে তারা অক্ষম।

গাড়ী নিয়ে যাচ্ছে এমন কাউকে দেখলেই ত্রাণের জন্য ছুটে আসে রোহিঙ্গারা

সাম্প্রতিক ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে সেনা অভিযান শুরুর কয়েক দিনের মাথায় ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গারা ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের সমন্বিত হামলায় অন্তত ১০৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়ে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান জোরদার করে সরকার। এরপর থেকেই মিলতে থাকে বেসামরিক নিধনযজ্ঞের আলামত। পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশছে মৌসুমী বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ছেন সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হচ্ছে তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষকে। আহত শরণার্থী হয়ে তারা ছুটছে বাংলাদেশ সীমান্তে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মুখে এ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এতো অল্প সময়ে এই বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশ করায় বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। তবে, এসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা মনে করা হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক এবিসি নিউজের খবরে উঠে এসেছে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের বিপন্নতার চিত্র। একটি অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরের নেতা নূর মোহাম্মদকে উদ্ধৃত করে এবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন শরণার্থী যারা এসেছে তাদের অনেকেই দুই দিন ধরে কিছু খায়নি। অনেকেই তিন দিন ধরে অভুক্ত আছে। তাদের রান্না করার মতো কিছু নেই, কিছু একটি বিছিয়ে যে ঘুমাবে সেরকম কিছুও নেই। অনেক শিশুর কোনও পোশাক নেই গায়ে, তারা উলঙ্গ অবস্থায় আসছে। নূর মোহাম্মদ এবিসি নিউজকে জানান, শরণার্থীদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তীব্র অভাব রয়েছে। সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

নিজে না খেয়ে অভুক্ত ৩ সন্তানকে খাওয়াচ্ছে রোহিঙ্গা সাজেদা। ছবি শনিবারের।

প্রাণের ভয়ে সবকিছু ছেড়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা জানিয়েছিল, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়া এলাকাগুলোতে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক নতুন টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এবিসি নিউজ জানিয়েছে, কুটুপালং শরণার্থী শিবিরের চারদিকে দুর্ভোগ ও দুর্দশা চোখে পড়ে। পুরো পরিবার, অসুস্থ মানুষ, আহত মানুষ, বৃদ্ধ থেকে নবজাতকরা একটু আশ্রয়, খাবার ও পানির জন্য হাহাকার করছে।
একটি অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে আলি জোহার ও তার স্ত্রী খুদিজা। বিধ্বস্ত ও নির্বাক খুদিজার কোলে দুই দিনের এক নবজাতক। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ পালিয়ে আসার পথে জঙ্গলে এই শিশুর জন্ম হয়েছে। মেয়েটির এখনও নাম রাখা হয়নি। কিন্তু তার জীবন শুরু হয়েছে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে, যেখানে নেই বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন বা বেঁচে থাকার মতো সব সরঞ্জাম। নবাজতক মেয়ের বাবা আলি জোহার জানায়, ‘আমি দুই দিন আগে বাংলাদেশ এসেছি। কারণ কয়েকজন বৌদ্ধ এসে আমাদের ছুরিকাঘাত করতে থাকে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। আমার বাড়ি পুড়ে গেছে। সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি।’
ইউএনএইচসিআর-র বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার শিন্নি কুবো বলেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে, আরও মানুষ আসবে। তাদের জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের বিশাল অংকের আর্থিক সহেযাগিতা প্রয়োজন। এমন ঘটনা নজিরবিহীন। এই পরিস্থিতি আকস্মিক। আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে এই পরিস্থিতি চলবে।’
ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র বলেন, এই পরিস্থিতিতে আমরা দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রথমত জরুরি প্রয়োজন যা জীবন বাঁচাতে দরকারি। যেমন- মানুষকে খাবার, পানি ও থাকার ব্যবস্থা করা এবং যদি চিকিৎসা সহযোগিতা প্রয়োজন তা দেওয়া। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আরও ভূমি কেনার বিষয়ে আলোচনা করছি। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে চরম অবস্থা তৈরি হতে পারে। অতিরিক্ত মানুষের ফলে স্বাস্থ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এমনকি স্থানীয়দের সঙ্গেও উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। ফলে সতর্কতা ও ভালোভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা দরকার মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, নতুন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের একসঙ্গে এক জায়গায় রাখা, তালিকা তৈরি, গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলাসহ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করে সীমান্ত আরও সুরক্ষার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।