সিবিএন ডেস্ক:
অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে নির্মূল করে বাংলাদেশ সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলার নীতি অবলম্বন করছে মিয়ানমার। আর রোহিঙ্গা নিধন করতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সমর্থন নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবেই মিয়ানমারের ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেইফ জোন বা নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা এবং শান্তিরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেয়ার যে পরিকল্পনা নিয়ে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া তা বাস্তবায়ন সম্ভব না। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে রয়েছে মিয়ানমারের প্রতি চীনের প্রকাশ্য সমর্থন। মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা প্রভাব ঠেকাতে রাশিয়াও নিরাপত্তা পরিষদে সক্রিয় রয়েছে। আর ভেটো ক্ষমতার অধিকারী এই দুই দেশের সমর্থন ছাড়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব অনুমোদন করা যাবে না।
এ ব্যাপারে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার লিয়াকত আলী আজ নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন বন্ধে নানাবিধ প্রস্তাব আনা যেতে পারে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাসও হতে পারে। কিন্তু সাধারণ পরিষদে নেয়া প্রস্তাবের নৈতিক প্রভাব থাকলেও আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। এজন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন। আর চীন ও রাশিয়ার স্বার্থ থাকায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব অনুমোদন বেশ কঠিন। তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন নিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা এবং জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা দেয়ার প্রস্তাব অনুমোদনের চেষ্টা বাংলাদেশ করতে পারে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত। কেননা এই ইস্যুতে তারা মিয়ানমারকে মানবাধিকার নিয়ে চাপে রাখতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এতোটাই ব্যস্ত যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে এখনো ঠিকভাবে ঢেলে সাজানো যায়নি। তার ওপর উত্তর কোরিয়ার সাথে উত্তেজনা রয়েছে চরমে। তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে ট্রাম্প প্রশাসনের দুই সপ্তাহ সময় লেগেছে। আর এ সুযোগটাই নিয়েছে মিয়ানমার। রাখাইন সংকট নিরসনে আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিনই রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হয়ে যায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভূমিকায় কিছুটা অবাক হয়েছেন উল্লেখ করে লিয়াকত আলী বলেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে বলে বারবার বলা হয়। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে রোহিঙ্গার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য ভারত সহায়ক কোনো ভূমিকা পালন করল না। উল্টো মিয়ানমারের সাথে সহমত প্রকাশ করল। তবে এক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে ভারতের তীব্র প্রতিযোগিতাকে বিবেচনায় নিতে হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতামতকে পক্ষে এনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ থেকে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বা বিশেষ দূতকে প্রভাবশালী দেশগুলোতে পাঠানোর পরামর্শ দেন তিনি।
কাঁটাতারের বেড়া
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের মুখপাত্র নেপিডোতে বলেছেন, বাংলাদেশের সাথে ১৭০ কিলোমিটার সীমান্তের বাকী ৪০ কিলোমিটার কোনো রকম বিলম্ব ছাড়াই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হবে। এই বেড়া নির্মাণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না। তবে যেকোনো উপায়ে এই বেড়া নির্মাণ করা হবে। এজন্য আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না।
বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে মূলত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনরোধ এবং তাদের রাখাইন রাজ্য ছাড়া করার উদ্দেশ্যে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান চলাকালে এই কাঁটাতারের বেড়া কেটে দেয়া হয় যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে পারে। এবার রোহিঙ্গা নির্মূলের চূড়ান্ত অভিযান চলছে। বাংলাদেশের অনুরোধ-প্রতিবাদ দূরের কথা, আন্তর্জাতিক কোনো চাপকে গ্রাহ্যই করছে না মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী মনে করে। আর তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ে সীমান্ত সিল করে দিতে চায় মিয়ানমার।
রাখাইনে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাস ছিল। এখন তার একটি বড় অংশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাকীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গত নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান শুরুর পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হিসাবে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের প্রবেশ করেছে। ২৫ আগস্ট অভিযানের পর এই সংখ্যা দুই লাখ ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর তার আগে থেকেই প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বৈধ-অবৈধভাবে বাংলাদেশে ছিল। ২০০৫ সালের পর বারবার আশ্বাস দিয়েও বাংলাদেশ থেকে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত নেয়নি। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তানে দুই লাখ, থাইল্যান্ডে এক লাখ, মালয়েশিয়ায় ৪০ হাজার, ভারতে ৪০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে ১২ হাজার ও ইন্দোনেশিয়ায় ১১ হাজারেরও মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা বাস করছে। অনেকেই সেখানে গেছে বাংলাদেশী পরিচয়ে। অর্থাৎ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা নির্মূলে মিয়ানমার তার লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সামাল দিতে জাতিসঙ্ঘের সামর্থে ঘাটতি
রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সামাল দিতে জাতিসঙ্ঘের সামর্থে ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্বসংস্থার শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান। আজ আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। আল-জাজিরার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল দুই লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীর সামাল দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ্য জাতিসঙ্ঘের রয়েছে কি না। জবাবে ভিভিয়ান বলেন, ‘না নেই, এই অবস্থায় নেই। শরণার্থী সংখ্যা অনেক এবং তা বেড়ে চলেছে।’
ভিভিয়ান আরো বলেন, গত কয়েকদিন ধরে জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিও অনেক স্থানে দ্রুত পর্যবেক্ষণের জন্য গিয়েছে। আমরা এমন কিছু এলাকায় গিয়েছি যেখানে শরণার্থীরা আছে বলে আগে জানতাম না। ওই সব স্থানে নতুন শরণার্থীরা এসেছেন। রাস্তার দুই পাশে এবং গ্রামেও অস্থায়ী বসতি গড়ে উঠছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে আমার যে চিত্র দেখেছি, তাতে আমাদের কী প্রয়োজন তা জানা গেছে। এখন তহবিলের জন্য আমাদের আবেদন জানাতে হবে। কেননা আমাদের যথেষ্ট সামর্থ্য নেই।
দৈনিক নয়াদিগন্ত
রোহিঙ্গা নির্মূল করে কাঁটাতারে সীমান্ত ঘিরে ফেলছে মিয়ানমার
পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে
