মাহবুবা সুলতানা শিউলী :

ওরা আজ অসহায়। এতটাই অসহায় নিজ দেশে থেকে ও পরবাসী। ওদের পাশে কেউ নেই। নিজ দেশের শাসক গুষ্টির নির্মম অত্যাচারে ওরা জর্জরিত। সবাই কম-বেশি জানি বার্মায় প্রতিনিয়ত কী ঘটছে?

আরাকানের রোহিঙ্গাদের কি নির্মম স্টিমরোলার চালাচ্ছে নাসাকা জান্তা সরকার অপারেশন চোয়াব নামে। সংখ্যালঘু হিন্দু মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচার। যে নির্যাতনের ভাষা কোন অভিধানে নেই। এমন লোমহর্ষক অত্যাচার যা হয়তো কোনো টিভি মুভির রূপকথার নিষ্ঠুর গল্পতেও নেই।

লাশের পরে লাশ জমছে। গ্রামের পর গ্রাম পোড়াচ্ছে। বাচ্চা মেয়েদের ধর্ষণের পর গুলি করে লাশ পুড়িয়ে ফেলছে। আবার সেই লাশ গর্ত করে পুঁতে ফেলছে। সাগরে ভাসছে লাশ আর লাশ। গর্ভবতী মহিলার পেট কেটে বাচ্চা বের করে উল্লাস করেছে নরপশুরা। কিছুক্ষন পর সেই বাচ্চাকেই গুলি করে হত্যা করছে।

ঘুমন্ত অবস্থায় জ্বালিয়ে দিচ্ছে শতাধিক ঘরবাড়ি। জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মরছে কিছু বুঝে উঠার আগেই। নিজেদের ঘরবাড়িতে পিঠ ঠেকাতে না পেরে কেউ কেউ হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র,বরণ করছে শহিদী মৃত্যু,কেউবা আহত। এ ছাড়া কিবা আছে। পৃথিবী চুপ আর মিয়ানমার সরব অত্যাচারে। ধুঁকে ধুঁকে মরছে চিকিৎসার অভাবে।

কেউ কেউ শরীরের জখম নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে সীমান্তে। যারা পালিয়ে আসছে,তারা নানাভাবে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে কোনভাবে বাংলাদেশে আসতেছে। হে নাফ নদী, তোমার উপর ঘৃনা জম্মাচ্ছে কোটি কোটি মানুষের। তোমার জলে মানবতার সলিল সমাধি আজ। বড় অসহায় আমরা এমন দিনেও তাদের পাশে দাড়াতে দেরি করছি। একজন মুসলিম যদি মুসলিমের বিপদে না আসে তবে কে আসবে তবে আমাদের পাশে।

এই ভরা বৃষ্টির মৌসুমে মাথার উপরে নেই চালা, পরনের জন্য নেই বস্ত্র আর পেটে নেই দু’মুঠো অন্ন। আমরা তো আর এখান থেকে কিছুই করার ক্ষমতা রাখি না। তবে জাগ্রত হোক বিশ্ববিবেক আর বন্ধ হোক এই পাষবিক খেলা। কিন্তু চেষ্টা করলেই আমরা অন্তত কিছু রোহিঙ্গা ভাই-বোনদেরকে আমাদের পরনের পুরানো একটি কাপড় , দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন এবং হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে থাকা মানুষ গুলোর জন্য কিছু ওষুধ নিয়ে পাশে দাড়াতে পারি।

এই অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা মারাত্মক জখম হওয়া কিছু ধর্ষিতা বোন , শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলি আর স্প্রিন্টারবিদ্ধ কিছু ভাই , আগুনে জ্বলসে যাওয়া শরীর নিয়ে কিছু মায়েদের ঠাঁই হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন ওয়ার্ডে I যাদের সংখ্যা মিডিয়ার বক্তবে পাঁচ। পালিয়ে আসা এই অসহায় মানুষগুলো বুঝেনা এদেশের ভাষা ,হাতে নাই টাকা ,পাশে নাই প্রিয়জন।

নির্বাক চাহনিতে ওরা শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এদেশের মানুষগুলোর দিকে। ওদের ভরসা একমাত্র এই জনপদের মানবতাবাদী মানুষগুলোর সাহায্য। সব হারিয়ে এই নিঃস্ব মানুষ গুলোর যে আর কেউ নেই। ভাল হলেই ওদের অধিকাংশই ফিরে যেতে চায় আবার ওই মৃত্যুপুরীতে নিজ ভূমিতে। যেখানে তাদের পিতৃপুরুষ দাদামহ মিয়ানমার সেনা বাহিনীর হাতে মৃত্যু বরণ করেছিলো। প্রিয় গ্রাম প্রিয় মাটি এতো নির্যাতন তারপরেও স্বদেশের প্রতি কবি ভাষায় এতো টান।

এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন ওদেরকে আশাবাদী করে তুলে। এই অবস্থায় ও ওরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্রষ্টার কাছে দু হাত তুলে প্রার্থনা করে। কারণ যাই হোক ,এই মুহূর্তে ওদের বড় পরিচয় ”ওরা অসহায় নির্যাতিত মানুষ। যে করেই হোক ,এই মারাত্মক জখম নিয়ে যারা আমাদের দোরগোড়ায় আসতে পেরেছে -তারা কী বিনা ওষুধে মারা যাবে ? না পাশে দাড়ানো মানবিকতা সকলে ভাবি স্ব স্ব জায়গা হতে। এক কাপড়ে যারা এসেই পড়েছে ,তাদের জন্য আরেকটা পুরানো কাপড়ও আমাদের ঘরে নেই কি!!সকল বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে মানুষ হয়ে অন্তত অসহায় মানুষ গুলোর চিকিৎসা ও সম্ভ্রম নিবারণের জন্য আমরা এগিয়ে আসি I যার যেভাবে সম্ভব, যে যতটুকু পারেন, কিছু অন্তত করি মানুষ হিসাবে। যারা সরাসরি এসে সাহায্য করতে চান চলে আসুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে।

নিজ চোখে দেখুন ,কী প্রয়াজন নিজ কানে শুনুন , সরাসরি নির্যাতিতদের সাথে কথা বলুন I অন্তরে মায়া হলে কিছু অন্তত করুন এই প্রত্যাশা আমাদের বিবেকের। আর যাদের আসার সুযোগ নেই। অন্তত একেক জনের জন্য কিছুদিনের ওষুধের দায়িত্বটুকু নিতে পারি সকলে। একা সরকারের পক্ষে লাখো মানুষের পাশে দাড়ানো অনেকটা কষ্টকর।

আমরা যারা চোখে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি এসব দৃশ্য। তাতে বলতে পারি টাকা পাঠাতে যদি অবিশ্বাস হয়। প্রয়োজনীয় জিনিসটুকু কিনে পাঠান। টাকা না পাঠান অন্তত আপনার ঘরের পুরনো চাদর , লুঙ্গি , ফেলে দেয়া কাপড় টুকু পাটিয়ে দিই। মনে হচ্ছে এ মুহুর্তে ওদের অনেক উপকারে হবে। কিছু করতে না পারেন অন্তত একটুখানি সময় দিয়ে ,সেবা দিয়ে ,মমতা দিয়ে ওদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন।

হাতে সময় সুযোগ থাকলে যোগ দিন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। মানুষের বিপদে মানুষ এগিয়ে না আসলে আর কে আসবে বলুন। সহযোগিতার প্রতীক্ষায় ওরা। ওরা রোহিঙ্গা নয় ওরা মানুষ। ওরা অমানুষ নয় ওরা মুসলিম। ওরা প্রতিবাদী হতে পারেনি তবে প্রতিহিংসা আর নির্যাতনের শিকার। জয় হোক মুসলিম জনতার,পাশে দাড়ায় সকলে মানবিক দৃষ্টিতে।

লেখকঃ মাহবুবা সুলতানা শিউলী, সদস্য, বোর্ড অব ট্রাস্টিস, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি।