ডেস্ক নিউজ:
বাবা-মা, ভাইবোন হারিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা তরুণী ছেনোয়ারা বেগমমিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের অগ্নিসংযোগ ও গুলিতে নিহত হয়েছে মা-বাবা ও পাঁচ ভাইবোন। একা প্রাণে বেঁচে যান ১৯ বছর বয়সী ছেনোয়ারা বেগম। এরপর প্রতিবেশীদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম নো-ম্যান্স ল্যান্ডে। সেখানে প্রায় এক সপ্তাহ আটকা থাকার পর প্রবেশ করতে পেরেছেন বাংলাদেশে। যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তিনি এসেছেন, তারাই এখনও মাথা গোঁজার স্থান পাননি; ছেনোয়ারাকে কে কোথায় রাখবেন? তারপরও সব হারানো এই তরুণীর হাত ছাড়ছেন না প্রতিবেশী খাইরুন্নেসা (৪০) ও নূর বেগম (৫০)। তাদের সঙ্গেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে বেঁচে আছেন ছেনোয়ারা।
বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) ছেনোয়ারাকে নিয়ে খাইরুন্নেসা ও নূর বেগম অবস্থান করছিলেন বালুখালী ঢালের পাহাড়ে। সেখানে বসেই তারা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে বলছিলেন ছেনোয়ারার জীবনের করুণ অধ্যায়ের কথা। ছেনোয়ারার চোখে তখন জল টলমল, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে খোলা আকাশের দিকে। সর্বস্ব হারিয়ে বাকরুদ্ধ যেন। তাই তার জীবনের কথা, পরিবারের সদস্যদের কথা জিজ্ঞাসা করলেও কোনও উত্তর মেলে না তার কাছে। সঙ্গে থাকা প্রতিবেশীরাই তার হয়ে জবাব দেন। তারা বলছেন, ছেনোয়ারাকে কিছু খেতে দিলে খায়, না দিলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে একাই বসে থাকে।

খাইরুন্নেসা বলেন, ছেনোয়ারার বাবার নাম রুহুল আমিন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে ছেনোয়ারা ছিল পঞ্চম। মংডুর পোহাহালি বা পোয়া সং এলাকায় তাদের বাড়ি। বাবা কৃষিজীবী। ২৪ আগস্ট রাতে ছেনোয়ারার পুরো পরিবার যখন গভীর ঘুমে, তখনই তাদের বাড়িতে আগুন দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ। আগুনের আঁচে তাদের ঘুম ভাঙলে ছুঁড়তে শুরু করে গুলি। একে একে ছেনোয়ারার চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা। কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যায় ছেনোয়ারা।
এক পর্যায়ে মুখ খোলেন ছেনোয়ারাও। অশ্রুসজল চোখে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ঘরে আগুন দেওয়ার পর সবাইকে সারিবদ্ধ করে শোয়ায়। এরপর গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলে। আমার তিন ভাই, দুই বোনকেও গুলি করে মেরে ফেলে। আশপাশের বাড়িতেও একই ঘটনা ঘটছিল। সবাই তখন পালাচ্ছিল। আমিও সবার সঙ্গে পালাতে শুরু করি। বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। সঙ্গে কিছুই আনতে পারিনি। ওই একই পোশাকে আছি এই দুই সপ্তাহ ধরে। কিছু পেলে খাচ্ছি, না পেলে খাচ্ছি না।’
ভয়াবহ অমানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া এই রোহিঙ্গা তরুণীর এখন প্রশ্ন একটাই— ‘এই দুনিয়ায় তো আমার আর কেউ নাই। আমি এখন কোথায় যাবো?’
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট রাখাইনে একটি পুলিশি তল্লাশি চৌকিতে সশস্ত্র হামলায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত ১২ সদস্য মারা যায়। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে অভিযানের নামে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, গুলি করে মেরে ফেলা হয় রোহিঙ্গাদের। প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে চলে আসেন। ধারণা করা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর দমন-নিপীড়ন সহ্য না করতে পেরে পায়ে হেঁটে ও সমুদ্র পথে বাংলাদেশে আসতে গিয়েও অনেক রোহিঙ্গাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। এদের মধ্যে নৌকাডুবিতেই বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সীমান্ত থেকে যেন রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে ফিরতে না পারে, সেজন্য মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় মাইন পুঁতে রাখার অভিযোগও পাওয়া গেছে।