রফিক মাহমুদ, সীমান্ত থেকে ফিরে:
গত ১৪ দিনে প্রায় ২ লাখ ৫০হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের জন্য নেই বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যবস্থা। তাই রোগ-বালাইসহ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানিয়রা। যাতে রোহিঙ্গাদের সাথে আক্রান্ত হতে পারে বাংলাদেশের স্থানিয় বসবাস কারি বাসিন্দরা। বিশেষ করে উখিয়া-টেকনাফের সাধারন মানুষ গুলো চরম ঝূকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে বলে তারা দাবি করছেন। এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং থেকে থাইংখালী পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু অবস্থান নিয়েছে। তাদের কেউ বনভূমি দখল করে অস্থায়ী আবাস তৈরি করছে। কেউ কেউ অবস্থান করছে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের দুইপাশে। আবার কেউ হেঁটে বা ছোট ছোট যানবাহনে চলে যাচ্ছে অজনা স্থানে। আবার কেউ কেউ ত্রাণের জন্য ছুটা ছুটা করছে।
কক্সবাজারে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ভিভিয়ান তান জানিয়েছেন, ২৫ আগস্টের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত আনুমানিক ১ লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। তবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কর্মরত স্থানীয় এনজিওগুলোর ধারণা এই সংখ্যা অনেক বেশি। সীমান্তের অন্তত ৩৫টি পয়েন্ট দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রতিদিনই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ইতিমধ্যে যে হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই প্রশাসন সহ কারও কাছে। স্থানিয়রা এই সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার পেরিয়ে গেছে বলে ধারনা করছে। উখিয়া টেকনাফের ছোট্ট জায়গায় একসাথে কয়েকলাখ মানুষ বসবাস করতে একধরনের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, গত কয়েকদিনে প্রায় ২লাখ ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তারা চরম খাদ্য ও পানি সংকটে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশা পাশি স্থানিয়দের জন্য খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের অশংকা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার ইতি মধ্যে বনবিভাগের কিছু জায়গা নির্ধারন করেছে। শীঘ্রই তাদের একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। আর যারা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সাহয়তা করে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নিচ্ছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দালালদের ব্যাপারে সজাগ রয়েছে।
গতকাল দুপুরে উখিয়া বালুখালীর ঢালায় গড়ে উঠা রোহিঙ্গা বস্তি ও সীমান্তে জিরোপন্টে ঘুমধুম পরিদর্শনে গেলে কয়েকজন রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের যেখানে পাচ্ছে গুলি করে মারছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন পাড়া জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বহু রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি, সহায় সম্বল ফেলে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে গেছে। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে এখন স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ফলে নতুন করে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। কুতুপালং ক্যাম্পের অদূরে টিভি টাওয়ার সংলগ্ন পাহাড়, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের পাহাড়, থাইংখালীর তাজনিমার খোলা, হাকিমপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে নতুন বস্তি। আর বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা খাদ্য সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে মংডু থেকে আসা আব্দুল হাকিম নামের একজন জানিয়েছেন। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো বেশিরভাগ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেগুলো অক্ষত রয়েছে সেখানে জনমানবশূন্য। এসব গ্রাম থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে রয়েছে। তারাও যে কোনো সময় বাংলাদেশে ঢুকবে। তিনি আরও জানান, রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহী রোহিঙ্গা গ্রুপ আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াইয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে
রাখাইনের রাচিদং থেকে আসা মোঃ কালো (৫০) জানান, তার পরিবারের ৮ জনকে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। ৩১ আগস্ট রাতে রাচিদং এলাকার রাজারপাড়ায় হামলা চালায় সেনারা। হামলার সময় গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় তার ভাই মোহাম্মদ সালাম, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং ৫ নিকটাত্মীয়কে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার বাড়িসহ পুরো গ্রাম।
নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা খাদ্য সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্থানীয় লোকজন কিছু কিছু এলাকায় রান্না করা খাবার বিতরণ করলেও অধিকাংশ স্থানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা খাবার পাচ্ছে না। অনেকে অসুস্থ এবং আহত অবস্থায় পালিয়ে আসছে, তাদের চিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিমও নেই। কক্সবাজারে ইউএনএইচসিআরের এক মুখপাত্র জানান, তারা কুতুপালং ও নয়াপাড়া ক্যাম্প এবং লেদা বস্তিতে সীমিতসংখ্যক রোহিঙ্গার মধ্যে শুকনো খাবার সামগ্রী বিতরণ করেছেন। অন্যান্য স্থানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে এই পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব রাখা হয়নি
টেকনাফে বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, বিজিবির সতর্কতা সত্ত্বেও বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা ঢুকছে। তাই তাদের এক স্থানে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলাচ্ছি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা ।