টেকনাফের প্রধান সড়ক ও উপকুলে রোহিঙ্গার ঢল

হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ :

দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা আনতে টেকনাফ উপকুল থেকে কয়েক হাজার নৌকা মিয়ানমার যাতায়ত করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মানব পাচারকারী দালাল সিন্ডিকেড ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রশাসন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৩২ জন দালালকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা টেকনাফের প্রধান সড়ক ও উপকুলে রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। দেখলে যে কারও মনে হবে যেন টেকনাফ সীমান্ত খুলে দেয়া হয়েছে। ঈদের আগে ও পরে একাধিক নৌকা ডুবির ঘটনার পর অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা সতর্ক হলেও বর্তমানে টেকনাফের প্রধান সড়ক ও উপকুলে রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। সেন্টমার্টিনদ্বীপসহ পুরো উপজেলা জুড়ে দলে দলে রাত-দিন বিরামহীনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে।

স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, টেকনাফের উপকুলে কয়েক হাজার নৌকা সাগরে ও নদীতে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে এসব নৌকা ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কাজে। সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যে জানা গেছে টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিনদ্বীপ, শাহপরীরদ্বীপ, শাপলাপুর, বড়ডেইল, মাথাভাঙ্গা, মারিশবনিযা, শীলখালী, মহেশখালীয়া পাড়া, বাহারছড়া, হাদুর ছড়া, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, লম্বরী, মিঠাপানিরছড়া, জাহাজপুরা, উখিয়া উপজেলার ছেপট খালী, মন খালী ঘাটে এখন কোন নৌকা নেই। সব নৌকা দালালের সাথে আঁতাত করে রোহিঙ্গা আনার জন্য মিয়ানমার যাতায়ত করছে।

এদিকে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর, সাবরাং, সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউনিয়নের সীমান্ত পথে দলে দলে রাত-দিন বিরামহীনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে এবং তা অব্যাহত আছে। বাহারছড়া ইউনিয়ন বঙ্গোপসাগর উপকুলবর্তী ইউনিয়ন বিধায় এতদিন সরাসরি সেখানে অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কিন্ত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে উপকুলবর্তী বাহারছড়া ইউনিয়নেও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে। সরাসরি মিয়ানমার থেকে এনে ৪ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া সাগর তীরে রোহিঙ্গা খালাস শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। দালালরা নাকি জনপ্রতি ভাড়া নিচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা করে। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে স্বর্ণালংকার কেড়ে নিচ্ছে। দিনের বেলায়ও বাহারছড়া শামলাপুর সৈকতে সরাসরি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল।

অপরদিকে সাবরাং, বাহারছড়া ও শাহপরীরদ্বীপে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে দালাল সিন্ডিকেড চরমভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৩০ ও ৩১ আগষ্ট শাহপরীরদ্বীপ নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনা এবং লাশ উদ্ধারের পর প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়া সত্বেও দালাল সিন্ডিকেডের তৎপরতা বন্দ হয়নি। এমনকি ছোটখাট কয়েকজন দালালকে মোবাইল কোর্টে সাজা দেয়া এবং বিক্ষুদ্ধ জনতা ৩টি ট্রলার ধ্বংস করে দেয়ার পরও লোভী দালালদের তৎপরতা বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।

অভিযোগে জানা যায়, শাহপরীরদ্বীপে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে মিস্ত্রীপাড়ার লম্বা সলিম, শরীফ হোছন, নাজির হোছন, মোঃ হোছন, এনায়তুল্লাহ, নুর হোছন এবং ঘুলাপাড়ার কবিরা। এরা সকলেই চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত দালাল। এসব সিন্ডিকেটে আরও কয়েকজন দালাল রয়েছে। এদের নেতৃত্বে শত শত বোট মিয়ানমারে গিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের টেকনাফে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এরা জনপ্রতি ১ থেকে ২ লক্ষ কায়াত (মিয়ানমার মুদ্রা) নেয়ার পরও বাংলাদেশের শাহপরীরদ্বীপ উপকুলে তীরে ভিড়ার আগে বোটের উপর স্বর্ণালংকার ও টাকা কেড়ে নিতে ধস্তাদস্তির কারণে বোট ডুবির মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে। এদের দেখাদেখি আরও কিছু নতুন দালাল সিন্ডিকেট সৃষ্টি হচ্ছে। তম্মধ্যে মিস্ত্রীপাড়ার লম্বা সলিম ও শরীফ হোছন, এবং ঘুলাপাড়ার কবিরা বিগত কয়েক যুগ ধরে এপার-ওপার ব্যবসা করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় মানব পাচারে পারদর্শী হয়ে উঠেছে বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে।

মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে দালালদের মাধ্যমে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদর, সাবরাং, সেন্টমার্টিনদ্বীপ ও বাহারছড়া ইউনিয়নের সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে শুধু ২ রাতেই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী সুত্র নিশ্চিত করেছে।

হোয়াইক্যং মডেল ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওঃ নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন এ পর্যন্ত কত জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে তার সঠিক সংখ্যা নিরুপন করা সম্ভব নয়। কারণ রোহিঙ্গারা বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে লোকালয়ে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং এদিক-সেদিক চলে যাচ্ছে।

বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মাওঃ আজিজ উদ্দিন বলেন রাতে ও দিনে (৫ সেপ্টেম্বর) কমপক্ষে ৬ হাজার পরিবার রোহিঙ্গা সরাসরি ট্রলার যোগে এসে বাহারছড়া ইউনিয়নের সৈকত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। পুলিশ-কোস্টগার্ডসহ এদের প্রতিহত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া ৬ জন দালালকে আটক করা হয়েছে। সাগর দিয়ে সরাসরি রোহিঙ্গা অনুপ্রবশ প্রতিহত করতে ৫ সেপ্টেম্বর পুরো ইউনিয়নে মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে। মাছ শিকারের ট্রলারগুলো যাতে রোহিঙ্গা আনার জন্য মিয়ানমার যাতায়ত না করে সে জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

সেন্টমার্টিনদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নুর আহমদ বলেন দ্বীপের কোন ফিশিং ট্রলার আমার জানা মতে রোহিঙ্গা আনার জন্য মিয়ানমার যাতায়ত করছেনা। তা সত্বেও মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় কোস্টগার্ড সাগর থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই ৩টি ফিশিং ট্রলার আটক করেছে। এ ট্রলারগুলোও সেন্টমার্টিনদ্বীপের নয়।