ডেস্ক নিউজ:
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তল্লাশিচৌকিতে হামলার জের ধরে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘাতে সেখানকার মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে।
এই পরিস্থিতিতে সেখানকার বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে এখনই সময় এসেছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আগামী মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও জোট।
মিয়ানমারের সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১০৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে নিরীহ লোকজন, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য রয়েছেন।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইটের চিত্র বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, গত শুক্রবার থেকে রাখাইনের অন্তত ১০টি এলাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত সোমবার ও গতকাল ঢাকা, ব্রাসেলস ও নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিয়ানমারের পরিস্থিতি আলোচ্যসূচিতে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ ছাড়া তুরস্কসহ ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) বেশ কয়েকটি দেশও বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে যুক্ত করতে চাইছে। দুই সপ্তাহ পর অধিবেশন শুরুর আগের সময়টাতে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রাখাইনে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার জন্য মিয়ানমারকে আহ্বান জানাতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
রাখাইনের সংঘাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস নিউইয়র্ক থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র অ্যাড্রিয়ান এডওয়ার্ডস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহ্বান জানান। রাখাইনের বিপর্যস্ত এসব লোকের মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সব ধরনের সহযোগিতায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। সংস্থাটির মুখপাত্র গতকাল এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসের শিকার মানুষের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস ওয়েলস গতকাল ঢাকায় মিয়ানমারের এখনকার পরিস্থিতিকে ‘যথেষ্ট উদ্বেগজনক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দুই দিনের সফরে গতকাল সকালে ঢাকায় এসে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বৈঠক করেন। এ সময় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে, বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপসহ বিস্তারিতভাবে মার্কিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মাহমুদ আলী এ সময় কফি আনানের নেতৃত্বাধীন রাখাইন রাজ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতি বাংলাদেশের পুরোপুরি সমর্থনের বিষয়টিতে জোর দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার ব্যবস্থা নেবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মাহমুদ আলী যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতা চান।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশ্নে গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানিয়েছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান রাখাইনের পরিস্থিতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আলোচ্যসূচিতে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। রাখাইনে অস্থিরতায় সক্রিয় ভূমিকা না রাখায় তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করেন।
এদিকে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মেরসুদি গতকাল জাকার্তায় এক সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারের সব পক্ষকে অবিলম্বে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ, রাখাইনে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা এবং মুসলিম সম্প্রদায়সহ রাজ্যের সব মানুষকে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। রাখাইনের পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল অবহিত করে তিনি বলেন, রাজ্যের শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নে সব পক্ষের সহযোগিতা জরুরি। আনান কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নসহ মিয়ানমারের সংহতি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নে ইন্দোনেশিয়ার সমর্থন অব্যাহত থাকবে। রাখাইনের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নির্বিচারে বল প্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখা নিশ্চিত রাখতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল-হুসেইন গতকাল মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে গত শুক্রবার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব। এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে গেছে। পরিস্থিতিটা দুঃখজনক। এটা অনুমিত ছিল এবং তা এড়ানোও যেত।
ইইউর উদ্যোগ
ব্রাসেলসের একটি কূটনৈতিক সূত্র মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানায়, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আলোচ্যসূচিতে রাখতে যাচ্ছে ২৮ দেশের ইউরোপীয় জোট ইইউ। এ জন্য ৫ সেপ্টেম্বর ইইউর রাজনীতি ও নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটিতে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে। গতকাল ইইউর পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ইইউকে পররাষ্ট্র, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে পরামর্শ দেয় এই কমিটি।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।