রফিক মাহমুদ, সীমান্ত থেকে ফিরে:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপরে ফের নির্মম অত্যাচার, সীমান্তে স্থল ও আকাশ পথে মহড়া এবং বাংলাদেশের ভূখন্ডের দিকে কয়েকবার গুলিবর্ষণ করেছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে সীমান্তের নাইক্ষ্য ছড়ির,ঘুমধুম ও উখিয়ার পালংখালী এলাকায় এঘটনা ঘটে। উগ্রপন্থিদের দমনের নামে প্রতিদিন আগুন দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ও সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে দেশটির সরকারি বাহিনী। জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আলকিন’ ও ‘আরসা’র সদস্য দাবি করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এসব এলাকার যুবক ও পুরুষদের। ধরে নেওয়ার পর, এসব যুবক ও পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) সকালে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী সীমান্ত দিয়ে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী পুরুষের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।

ওই সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে আসা রাখাইন রাজ্যের মাদ্রাসার শিক্ষক মৌলভী জুনায়েদ আহমদ প্রতিবেদকে জানন, ‘আমি ঢেঁকিবনিয়ার মিয়ারপাড়া গ্রামের একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করি। সোমবার ২৮ আগস্ট হঠাৎ করেই একদল সেনাবাহিনী (তার ভাষায় লুন্ঠিত বাহিনী) এসে মাদ্রাসা থেকে আমাকে আটক করে। মুহূর্তে মাদ্রাসাটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আমাকেসহ আরও অনেককেই আটক করে একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে ধামনখালী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি।’

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে দেখা মেলে ৬০ বছর বয়সী মেহেরুন্নেছার। তিনি বলেন, ‘রাখাইনে আর যাওয়া হবে না। কারণ, সেনাবাহিনী পুরো রাখাইনজুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে। হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে বোমা ফেলছে। এ কারণে একের পর এক গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।’ তার সাথে আরও প্রায় ১ হাজারমত রোহিঙ্গা মঙ্গলবার সকালে কুতুপালং আনরেজিষ্ট্রার ক্যাম্পে অবস্থান নিয়েছে। সোমার দিবাগত রাতে প্রায় ৩হাজার রোহিঙ্গা উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং ঢুকেছে। এই নিয়ে গত ৬দিনে নাফনদীর জলসীমা, ঘুমধুমের তুমব্রু সীমানা পেরিয়ে ১৫ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আরও প্রবেশের অপেক্ষায় রেয়েছে প্রায় ২০ হাজার। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)এর এক কর্মকর্তা।

রাখাইনের অবস্থা খুবই ভয়াবহ উল্লেখ করে ওই রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া ইউনিয়নের মিয়ারপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ কালুর ছেলে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘রাখাইনে হয়তো আর বসবাস করা যাবে না। এখন কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন কোথায় যাবো, কী করবো, ক্যাম্পে গিয়েও সন্তানদের পেটে কী দেওয়া হবে, তা ভেবে পাচ্ছি না।’

সরেজমিনে মিয়ানমার সীমান্তের একাধিক পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকাশে কিছুক্ষণ পর পর একটি হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে পুনরায় মংডু শহরের দিকে চলে যাচ্ছে । রাখাইনে সহিংসতার পর থেকেই এভাবে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দেখা গেছে। সর্বশেষ ঘুমধুন সীমান্তের কাছাকাছি সেদেশের ক্যাম্পে ল্যান্ড করছে ওই হেলিকপ্টারটি। পরে হেলিকপ্টারটি চক্কর দেওয়ার পরপরই সীমান্তের কাছাকাছি রাখাইনের বিভিন্ন জায়গায় আগুনের ধোঁয়া দেখা যায়। শোনা যায় বিকট শব্দের গুলি ও মর্টার শেলের আওয়াজ।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোষ্টে হামলা চালায় সে দেশের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ। এতে ১২ পুলিশ সদস্যসহ অনেক রোহিঙ্গা হতাহত হন। এঘটনার পর প্রতিদিনই বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। নাফ নদীর জলসীমানা থেকে শুরু করে স্থল সীমানা পার হয়ে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা। এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবরের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একইভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। তখন প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। কিন্তু এর কোনও তোয়াক্কা না করে রাখাইনে ফের সেনা মোতায়েন করলে বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সে দেশের সেনা বাহিনী ও পুলিশ।